স্কুল খুললেও পড়াশোনায় ফিরতে পারেনি সব পড়ুয়া৷ যাঁদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, তাঁদের জন্যই এক শিক্ষক রাস্তায় শুরু করেছিলেন পাঠদান৷ তাতেই মিলেছে সাফল্য৷ স্কুল খুলে গেলেও বন্ধ হবে না ‘রাস্তার স্কুল’৷মঙ্গলবার থেকে পশ্চিমবঙ্গে খুলেছে স্কুল-সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ শুরু হয়েছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস৷ ধীরে ধীরে খুলতে পারে বাকি ক্লাসগুলিও৷ কথা ছিল, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে মিড ডে মিলের চাল-আলু নিতে আসার সময় অভিভাবকদের হাতে দেওয়া হবে পাঠ্য বিষয় বা অ্যাক্টিভিটি টাস্ক৷ কিন্তু শিক্ষকরাই গত দু'বছর ধরে বারবার বলেছেন, নানা কারণে এই পরিকল্পনা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হচ্ছে না৷ ফলে এই দু'বছর স্কুল বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে গিয়েছে অনেকটাই৷ এর ফলে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছিল স্কুলছুট হওয়ার আশঙ্কা৷এই সঙ্কট ভাবিয়ে তুলেছিল শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়ককে৷ পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়ায় তিলকা মাঝি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি৷ কোভিড বিধিনিষেধ ও লকডাউনের মধ্যে তিনি ‘দুয়ারে শিক্ষা' এনেছেন৷ বাংলা শিক্ষা পোর্টাল টাস্ক বিলির আগে থেকেই তিনি আদিবাসী শিশুদের পড়ানোর কাজ শুরু করেছেন৷ শিক্ষকের নিজের বেতনের টাকা থেকেই চলেছে পঠনপাঠন৷ এমনকী স্লেট, পেনসিল থেকে শুরু করে খিদে মেটানোর অনেকরকমের আয়োজন৷প্রথমেই সাড়া মিলেছিল, এমন নয়৷ গত বছর মে মাসে রাস্তার স্কুল খোলার সময় মাত্র পাঁচজন পড়ুয়া এসেছিল৷ তারপর এই রাস্তার পঠনপাঠনে ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে ওঠে দরিদ্র আদিবাসী পড়ুয়ারা৷ এখন সেই সংখ্যাটা ১০০০-এর বেশি৷ আদিবাসী গ্রামের মাটির বাড়ির দেওয়ালে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ব্ল্যাক বোর্ড লাগানো হয়৷ ফলে গোটা পাড়াই হয়ে ওঠে ক্লাসরুম৷ আর এ ভাবেই দীপনারায়ণ হয়ে উঠেছেন 'রাস্তার মাস্টার'৷ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার অধিকারে ৬-১৪ বছরের শিশুদের শিক্ষার কথা বলা আছে৷ তবে আমার ক্লাসে চার বছরের খুদেও পড়তে আসে৷ বাবা-মা কাজে চলে গেলে দাদা বা দিদির হাত ধরে সে-ও পড়তে আসে৷ আবার মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরাও আসে৷ তারাও তাদের সমস্যার কথাটা বলে৷’অনেক আগেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন দীপনারায়ণ৷ লকডাউনে তিনি দেখেন, একদিকে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ছেদ পড়েছে৷ তেমনই অভিভাবকেরাও কাজে যেতে পারছেন না৷ ৩৫ বছরের দীপনারায়ণ তাদের নিয়ে করোনা বিধি মেনে রাস্তার উপরেই ক্লাস শুরু করেন৷ দেড় বছর ধরে শুধু খুদে শিক্ষার্থীরা নয়, তাদের মায়েরাও সপ্তাহে একদিন লেখাপড়া শেখেন৷ এক্ষেত্রে খুদেরাই দেয় মায়েদের পাঠ৷ এভাবেই চতুর্থ শ্রেণির নমিতা বাগচি বা বৈশাখী মারান্ডি হয়ে উঠেছে তাদের মায়ের শিক্ষক৷ বৈশাখীর হাত ধরে তার মা বছর বিয়াল্লিশের বুধনি মারান্ডি শিখে ফেলেছেন নাম-সই৷আগে প্রতিটা পাড়াতেই বসত রাস্তার মাস্টারের শিক্ষাবান্ধব ক্লাস৷ এখন ১১টি কেন্দ্রে হয় পাঠদান৷ ইতিমধ্যে ‘রাস্তার মাস্টার’ শুরু করেছেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার৷ প্রান্তিক হওয়ার জন্য রেফারেন্স বই পায় না অনেকে। সেজন্য ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতায় গ্রন্থাগারের সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছেন রাস্তার পড়ুয়াদের কাছে৷ নিজস্ব ল্যাপটপ আর একটা মাইক্রোস্কোপ হাতিয়ার করে আদিবাসী সমাজের কুসংস্কার দূর করতেও চলে রাস্তার মাস্টারের অভিযান! করোনা টিকা হোক বা ম্যালেরিয়া সচেতনতা— শিক্ষকের কাছ থেকে আদিবাসীরা পাচ্ছেন নয়া দিশা৷ দীপনারায়ণ নিজের বিয়েতে আটটি অনাথ শিশুর সারা জীবনের দায়িত্ব নিয়েছেন৷ টানা কাজ করার সুবাদে এখন ‘রাস্তার মাস্টারকে’ চেনেন অনেকেই৷ অনেকে তাঁকে বিকল্প শিক্ষায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন৷ 'রাস্তার মাস্টারও' চাইছেন, তাঁর বিকল্প শিক্ষার প্রকল্প ছড়িয়ে পড়ুক অন্য জেলাতেও৷ ‘রাস্তার মাস্টার’ আপাতত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলতে চান৷ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার রাস্তার মাস্টারের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘এই চেষ্টাটাকে সকলের অনুকরণ করা উচিত৷ সমাজে যারা বঞ্চিত, তাদের প্রতি কর্তব্য পালনে তিনি এগিয়ে এসেছেন সবরকম ঝুঁকি নিয়ে৷ এই কাজ মানবজাতির কাছে দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত বলেই মনে করি৷'আস্তে আস্তে সব ক্লাসের জন্যই স্কুল খোলা হবে৷ তাহলে কীভাবে চলবে ‘রাস্তার মাস্টারের’ কর্মকাণ্ড? রাস্তার মাস্টার বলেন, ‘যাদের কাছে শিক্ষার উপকরণ নেই, তাদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া আমার মুখ্য ফোকাস৷ প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া এরা৷ বাড়িতে বাবা-মায়েরাও পড়া বুঝিয়ে দিতে পারেন না, টিউশনি নেওয়ার সামর্থ্য নেই৷ স্কুল খুলে গেলে এই সমস্যা মিটবে না৷ তাই স্কুলের পাশাপাশি এই কার্যক্রম চলবে৷ স্কুলের সময়ে আর ক্লাস করা যাবে না৷ তখন অন্য সময়ে করতে হবে৷’(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)