মৃণাল সেনের জন্মবার্ষিকীতে আবেগঘন পোস্ট সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রের। তিনি তাঁর কর্মজীবনের গোড়ার দিকের কথা তুলে ধরেছেন। তখন কিছুদিন মাত্র হয়েছে তিনি যোগ দিয়েছেন সলিল চৌধুরীর গানের ট্রুপে। তখন মৃণাল সেনের ছবি 'আকালের সন্ধানে'-এর কাজ চলছিল। সেখানে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীও। কালজয়ী সেই জনপ্রিয় গান 'হেই সামালো ধান হো...'র কাজ চলছে। দেবজ্যোতি মিশ্র সেই প্রথম চাক্ষুস করছেন মৃণা♏ল সেনের কাজ, সঙ্গে মৃণাল-সলিলের এক দারুণ যুগলবন্দী। কেমন ছিল সেই মুহূর্তগুলো? সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথাই তিনি সমাজ মাধ্যমের পাতায় ভাগ করে নিয়েছেন অনুরাগীদের সঙ্গে।
সঙ্গীত পরিচালক লিখেছেন, 'মৃণাল সেনের ছবি আকালের সন্ধানে। লোকেশান নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও। আছেন সলিল চৌধুরী, মৃণাল সেন, রেকর্ডিস্ট দুর্গাদাস মিত্র।... গান শেষ হল...। হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো। মৃণালদা ওঁর দীর্ঘক্ষণ ধরে না ফেলা সিগারেটের ছাইটা ফেললেন। চিরাচরিত ভঙ্গিমায় হাত রাখলেন বন্ধু সলিলের কাঁধে। আমি তখন সদ্য সলিল চৌধুরীর গানের ট্রুপে ভিড়েছি, সলিলদার ফ্রেন্ড সার্কেলকে কাছ থেকে কিছুই দেখা হয়নি☂ তখনও। কিন্তু 🅷সেদিন ওই ছাই ঝেড়ে ফেলা তীব্র চোখদুটো যখন সলিল চৌধুরীর আগুনচোখের দিকে তাকাল, স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম, আগুনের ফিজিকাল স্ট্রাকচার কাকে বলে! মৃণালদা আগুন বুনতেন ফ্রেমে। আর সলিল চৌধুরী বুনতেন আগুনের স্বরলিপি। দুই বন্ধু চিরকাল আগুনের মতন সততাকে নেতা বলে মেনেছেন। আর আগুন? তার কী সন্ধান? আগুন খোঁজে আকাল। কারণ, আকালকে সর্বাঙ্গে পোড়াতে না পারলে আগুনের জন্ম হয় না।'
মৃণাল সেনের কাজ ও ভাবনার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দেবজ্যোতি মিশ্র লিখেন, 'ফিল্ম কোম্পানির গাড়িগুলো গাঁয়ের পথ বেয়ে শোঁ শোঁ করে বেরিয়ে গেল। দূরে ধান খেত। ট্রেন লাইন। সেই সবুজ ধানের খেতের উপর হেই সামালো ধান হো কাস্তেটা দাও শান হো-র রোদের ঝিলিক। গাঁয়েরই একটা লোক-- গাড়িগুলোর দিকে চেয়ে স্বগতোক্তি করে, 'বাবু এয়েচেন আকালের ছবি তুলতে, আকাল তো আমাদের সব্বাঙ্গে!' সেই 'সব্বাঙ্গ আকালের' ছবিতে এখন সমস্ত পৃথিবীর মানচিত্র। অসহিষ্ণুতা আর ক্ষমতার আস্ফালন গ্রাম-নগরকে গিলে ফেলছে ক্রমশ, একটা বিশাল বিশ্বজনীন সাপের মতন। মৃণাল সেন এই সাপের সরসর ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে আর্ট। কারণ সৎ আর্টের কাজ মানুষকে নিয়েই। মানুষই পারে বিদ্রোহ কর📖তে। মানুষই পারে আগুন জ্বালতে! আর জানতেন বলেই তা��ঁর জন্মদিন কখনও ফুরোয় না। অনন্ত জন্মের মধ্যে একজন মৃণাল সেন হেঁটে চলেছেন।'
সঙ্গীত পরিচালকের মতে, মৃণাল সেনে ও সলিল চৌধুরীর দেখার ভঙ্গিটা অনেকটা মিলত, তাঁদের সেই অন্তরের সুতোই যেন তাঁদের অদৃশ্য এক বাঁধনে বেঁধেছিল। তাঁদের বন্ধুত্ব প্রস💖ঙ্গে তিনি লেখেন, 'তাঁর বন্ধু সলিল মারা গেছেন। ১৯৭৯-র সেই আকালের সন্ধানের পর, আমি মৃণালদাকে অনেকটা চিনি। আমি সেদিন ওই শোকের দিনেও যেন দেখত💯ে পাচ্ছি মৃণালদার চোখে তাঁর ভবিষ্যৎ বক্তব্য: পৃথিবী ভাঙছে পুড়ছে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, তবুও মানুষ বেঁচেবর্তে থাকে: 'মমত্বে, ভালোবাসায়, সহমর্মিতায়!' আমার ভুবন ছবিতে আমি কাজ করেছিলাম মৃণালদার সাথে, সঙ্গীত পরিচালক হয়ে। ছবির শেষে যখন মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে, গানটি বেজে উঠেছিল, মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ যেন মিলিয়ে দিলেন দুই বন্ধু মৃণাল সেন আর সলিল চৌধুরীরকে! যাঁরা সদা বাজা মানুষের জীবনের মৃদঙ্গের তান শুনতে পেয়েছিলেন। মৃণাল শতবর্ষ পেরিয়ে আর সলিল শতবর্ষের দিকে আগুনের পথে হেঁটে যাচ্ছেন। দুজন মশাল। দুজন অনন্ত জীবনের বন্ধু।'