ফের বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। কিন্তু এখনও সেই তুলনায় গুরুতর অসুস্থতা এবং হাসপাতালে ভরতির কেস অনেকটাই কম। করোনার আগের দুটি ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করে এমনটাই দেখা যাচ্ছে। আর তাই থেকেই যেন কিছুটা আশার আলো দেখছেন গবেষকদের একাংশ। তবে কি তৃতীয় ওয়েভ এলেও তা কম ক্ষতি করবে? উল্টে সেটাই মহামারী শেষে সাহায্য করবে?সান ফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ইমিউনোলজিস্ট মনিকা গান্ধী বলেন, 'আমরা এখন একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে আছি। যা মনে হচ্ছে, ভাইরাসটি সবসময়েই আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তবে আমার আশা এই ভ্যারিয়েন্টটি এতটাই অনাক্রম্যতা সৃষ্টি করবে যে এটিই পারতপক্ষে মহামারী দমনে সাহায্য করবে।'দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্র এক মাস আগে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কৃত হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য এখনও প্রচুর সময় রয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে ব্যাপক অনাক্রম্যতা এবং অসংখ্য মিউটেশনের সংমিশ্রণের ফলে একটি ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়েছে যা আগেরগুলির তুলনায় অনেক কম ক্ষেত্রে গুরুতর উপসর্গ সৃষ্টি করে।দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ওমিক্রন আক্রান্তদের হাসপাতালে ভরতির সংখ্যা ডেল্টা-প্রধানওয়েভের তুলনায় কম। একটু-আধটু নয়, গুরুতর রোগের সম্ভাবনা প্রায় ৭৩% কম ছিল। কেপ টাউন ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট ওয়েন্ডি বার্গার্স বলেন, 'এখন হাসপাতালে ভরতি রোগীর সংখ্যা এবং সবমিলিয়ে পজিটিভ কেসের সংখ্যা আলাদা করে গোনা হয়েছে। বলে ডেটার অভাব নেই।' প্রথমদিকে, ওমিক্রনের বেশির ভাগ শঙ্কা ছিল ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই স্পাইক প্রোটিনে রয়েছে। এটি হোস্ট কোষে আক্রমণ করতে সাহায্য করার জন্য দায়ী ভাইরাসের অংশ। প্রাথমিক ডেটা বলছে এই মিউটেশনগুলির ফলে ভাইরাসটি সহজেই টিকা-বিহীন লোকদের সংক্রমিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি পূর্ববর্তী সংক্রমণ এবং ভ্যাকসিন গ্রহণকারী, উভয়ের অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়াও এড়াতে পারে। কিন্তু এই প্রশ্নটি থেকেই যায় যে প্রতিরক্ষার প্রথম ধাপগুলি অতিক্রম করার পরে ওমিক্রন কীভাবে আক্রান্তের দেহে প্রভাব ফেলবে?কোভিড-১৯ এর আগের ওয়েভের তুলনায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটিকে কম গুরুতর (গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে) মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। একটি কারণ হল ভাইরাসের ফুসফুসকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা। কোভিড সংক্রমণ সাধারণত নাক দিয়ে শুরু হয় এবং গলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। একটি হালকা সংক্রমণ উপরের শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্টের চেয়ে বেশি দূরে বিস্তার করে না। তবে যদি ভাইরাসটি ফুসফুসে পৌঁছোয়, সেক্ষেত্রেই সাধারণত যখন আরও গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়। তবে গত সপ্তাহে পাঁচটি পৃথক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি আগের ভ্যারিয়েন্টগুলির মতো সহজে ফুসফুসকে সংক্রামিত করে না। জাপানি এবং মার্কিন বিজ্ঞানীদের একটি বড় কনসোর্টিয়াম দ্বারা একটি অনলাইন প্রি-প্রিন্ট হিসাবেও এর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ওমিক্রন দ্বারা সংক্রামিত হ্যামস্টার এবং ইঁদুরের ফুসফুসের ক্ষতি অনেক কম ছিল। তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনাও আগের ভেরিয়েন্টগুলির তুলনায় কম ছিল৷বেলজিয়ামের আরেকটি গবেষণায় সিরিয়ান হ্যামস্টারদের মধ্যে একই রকম ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। এই একই হ্যামস্টার আগের ভেরিয়েন্টগুলির ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল।হংকঙে গবেষকরা অস্ত্রোপচারের সময়ে রোগীদের থেকে সংগৃহীত অল্প সংখ্যক ফুসফুসের টিস্যুর নমুনা অধ্যয়ন করেন। তাতে দেখা যায়, অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন সেই নমুনাগুলিতে তুলনামূলকভাবে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে।কেপ টাউন ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট ওয়েন্ডি বার্গার্স বলেন, ভাইরাসের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের সঙ্গে ভাইরাসের এই 'চারিত্রিক' পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। 'আগে এটি কোষে প্রবেশের জন্য দুটি ভিন্ন পথ ব্যবহার করত। এখন স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তনের কারণে, এটি সেই পথগুলির মধ্যে একটিকেই বেছে নিচ্ছে,' ব্যাখ্যা করলেন তিনি। 'এটি ফুসফুসের চেয়ে উপরের শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্টকে সংক্রামিত করতেই বেশি পছন্দ করে বলে মনে হচ্ছে।' বার্গার্স বলেন, এর অর্থ হতে পারে যে, ওমিক্রনে কম গুরুতর সংক্রমণ হবে। তবে আরও সংক্রামক হওয়ায় ভাইরাসটি আরও সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে।ওমিক্রন অ্যান্টিবডির আক্রমণ এড়াতে ওস্তাদ। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় এটাও দেখা গিয়েছে যে টিকা এবং পূর্বের সংক্রমণের মাধ্যমে প্রাপ্ত দ্বিতীয় সারির প্রতিরক্ষা (টি কোষ এবং বি কোষ) এড়াতে এটি ততটাও সফল নয়। শরীরের অ্যান্টিবডি প্রথমেই সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে টি-কোষ কাজে নামে। এই পরিস্থিতিতে টি-কোষ ভাইরাসকে আক্রমণ করে। শরীরের কোষে প্রবেশ করার সময়ে এটি বাধা দেয়।বার্গার্স এবং তাঁর সহকর্মীদের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কোভিড রোগীদের শ্বেত রক্তকণিকা পর্যবেক্ষণ করেন। তাতে দেখা যায় যে ভাইরাসের আগের স্ট্রেনের তুলনায় প্রায় ৭০-৮০% টি-সেল প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা অক্ষত রয়েছে। এর মানে হল যাঁদের টিকা দেওয়া হয়েছে বা গত ৬ মাসে কোভিড সংক্রমণ হয়েছে, সম্ভবত তাঁদের টি-কোষগুলি ওমিক্রনকে ধরতে/চিনতে পারবে। ফলে তুলনামূলকভাবে দ্রুত এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। এই সর্বশেষ গবেষণায় এখনও বহু অধ্যয়ন ও অনুসরণ প্রয়োজন। তবে এই তথ্যের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, কেন এখন আগের ওয়েভের তুলনায় সংক্রমণ কিছুটা কম প্রভাবশালী বলে মনে হচ্ছে।কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের এপিডেমিওলজিস্ট জেসিকা জাস্টম্যান বলেন, 'যখন আপনি বিভিন্ন ধরনের ডেটা দেখতে শুরু করবেন, বুঝতে পারবেন যে সমস্ত পর্যবেক্ষণই একই দিকে ইঙ্গিত করছে।' তবে এসব ভেবে এখনই গা-ছাড়া ভাব করলে চলবে না। নতুন করোনা কেসের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে হাসপাতালে ভরতি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে। আগের তুলনায় অসুস্থতার তীব্রতা বা হাসপাতালে ভর্তি কমলেও, এখনও কিছু ক্ষেত্রে অসুস্থতা ও মৃত্যুর সম্ভাবনার মতো গুরুতর বিষয়কে অবহেলা করা যাবে না।যদি নতুন ভ্যারিয়েন্টে কম সংখ্যক অসুস্থতা হয়, তাতেও স্বস্তির কিছু নেই। কারণ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছড়ায় অনেক বেশি দ্রুত। ফলে আক্রান্ত জনসংখ্যাও অনেক বেশি হতে পারে। তার একটি সামান্য অংশের অসুস্থতা হলেও তা বিপুল চাপ সৃষ্টি করবে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। আর সেই কারণেই চিন্তিত সব মহল। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির মনিকা গান্ধী জানান, তিনি আশা করেন যে ওমিক্রনের উচ্চ সংক্রমণশীলতা এবং হালকা উপসর্গের সংমিশ্রণই মহামারী শেষের অস্ত্র হতে পারে। গত সপ্তাহে হংকঙের একটি গবেষণার উল্লেখ করেন তিনি। তাতে দেখানো হয়েছিল যে ওমিক্রন সংক্রামিত রোগীদের মধ্যে অনেকটাই শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এটি অন্যান্য করোনা ভেরিয়েন্টকে প্রতিরোধ করে দিচ্ছে। অর্থাত্ দ্রুত জনসংখ্যার একটা বড় অংশ সংক্রামিত হচ্ছে। কিন্তু তুলনায় গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন কম মানুষ। পাশাপাশি এক শক্তিশালী প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠছে শরীরে। ফলে আরও বিপুল শক্তিশালী কোনও ভ্যারিয়েন্ট না এলে এটিই হতে পারে কোভিডের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র। মনিকা বলেন, 'আশা করি এই ভ্যারিয়েন্টটি জনসংখ্যার মধ্যে গভীর অনাক্রম্যতা তৈরি করবে। এটিই মহামারীর বিনাশের চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।'