- সুদীপ ঘোষ
আজ এমন একটি বইয়ের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করব, যে বইয়ের বক্তব্য এই অস্থির সময়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। একটি ইংরেজি বইয়ের একটি অংশ। বইটি প্রকাশের শুরু থেকেই দুনিয়ার ‘বেস্টসেলার লিস্টে’ জায়গা করে নিয়েছিল। অধুনা নাম ‘ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং’। প্রকাশকাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পরের বছর। অর্থাৎ ১৯৪৬ সাল। লেখক ভিক্টর ই ফ্র্যাঙ্কলন। প্রথম প্রকাশ জার্মান ভাষায়। নাম ছিল, ‘আইন সাইকোলোগ এর্বডট ডাস কোরজেন্ট্যাসলামস্লেজার’। ইংরেজি ভাষায় তর্জমা করে প্রকাশ পায় সম্ভবত তার ১৩ বছর পরে, ১৯৫৯-এ। সেই বইয়ের নাম ছিল, ‘ফ্রম ডেথ ক্যাম্প টু এক্সিস্টেন্সিয়ালিজম’।
এই সময়ে বইটি আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ বইটি এক যুদ্ধের সময়ের কথা বলে। সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ভিক্টর ফ্রাঙ্কলন ছিলেন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের বাসিন্দা। মনোবিজ্ঞানী। সফল। এবং জন্মসূত্রে ইহুদি। স্ত্রী, মা, বাবার যৌথ সংসারে বসবাস। হিটলারের নাৎসি বাহিনী অস্ট্রিয়া দখল করে ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে। সে সময়ে অস্ট্রিয়ার বেশিরভাগ নাগরিক সুদিনের আশায় নাৎসিদের শাসন মেনে নেন। ফ্রাঙ্কলনের মতো হাতেগোনা কয়েক জন এই প্রভুত্ব মানতে পারেননি। সেটি একটি কারণ। দ্বিতীয়ত, তিনি জন্মসূত্রে ইহুদি। এই দুই কারণে ফ্রাঙ্কলন দম্পতিকে গ্রেফতার করে নাৎসিরা। অসউইৎজ ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’-এ তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের’ বাংলা তর্জমা কী হতে পারে? মারণভূমি খুব কাছাকাছি একটি শব্দ। কারণ এখানে বিষাক্ত ‘গ্যাস চেম্বার’-এ বন্দিদের ঢুকিয়ে দিয়ে খুব সহজেই মারা যেত। মূল লক্ষ্য ছিল বন্দিমৃত্যু। বন্দিদের হাতে দু’টি পথ খোলা থাকতো; হয় জার্মানদের যুদ্ধনির্মাণে সাহায্য করা, নয়তো ‘গ্যাস চেম্বারে’ মৃত্যু। ফ্রাঙ্কলনের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ভিক্টর স্বয়ং যুদ্ধ শেষে মুক্তি পেয়েছিলেন। ততদিনে অস্ট্রিয়ার বাসিন্দাদের জার্মান প্রেম ঘুচে গিয়েছে। সুতরাং অসউইৎজের অস্ট্রিয়ান বন্দিরা মুক্তি পেয়েছিলেন। জার্মানি তখন পরাজিত শক্তি।
সেই ক্যাম্পের জীবন ও তার থেকে প্রাপ্ত উপলব্ধিকে ভিত্তি করেই লেখা ‘ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং’। প্রথম পরিচ্ছেদটি আউসউইউইচ মারণভূমির মধ্যে বন্দি থাকার দিনগুলি নিয়ে। সেই অংশে ভিক্টর এমন কয়েকটি বাক্য গঠন করেছেন, যা ভীষণভাবে একজন কলকাতাবাসী বাঙালিকে ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম। লিখছেন, ‘বিকজ অফ দ্য হাই ডিগ্রি অফ আন্ডার নারিশমেন্ট দ্যাট দ্য প্রিজনার্স সাফার্ড, ইট ওয়াজ ন্যাচারাল দ্যাট দ্য ডিজায়ার ফর ফুড ওয়াজ দ্য মেজর প্রিমিটিভ ইন্সটিঙ্কট অ্যারাউন্ড হুইচ মেন্টাল লাইফ সেন্টার্ড।’ (বাংলা তর্জমা: প্রচণ্ড অপুষ্টিজনিত খাবার খেতে বাধ্য হওয়া ক্যাম্পের বন্দিদের মাথায় স্বাভাবিক ভাবেই যে ভাবনাটি মুখ্য হয়ে উঠেছিল দিনের পর দিন বন্দি থাকতে থাকতে, তা হল খাদ্যচিন্তা।) কীরকম খাবার খেতে বাধ্য করা হতো এই সব বন্দিদের? দিনে একবারই খাবার দেওয়া হত। খাবার আহরণ এবং বিতরণের ভার ছিল বেসরকারি পাইকদের উপর। তারা সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অর্থ হাতালেও, বন্দিদের পিছনে খরচ করত নামমাত্র। অন্তত লেখকের তাই মত। ভোরবেলা কাজে যাওয়ার সময়ে এক টুকরো শুকনো পাউরুটি (এক পাউন্ডও নয়) ছিল বরাদ্দ। এর পর মধ্যাহ্নে বিলি হত এক বাতি জ্যালজেলে আলুর স্যুপ। টিনের বাটির মধ্যে আলুর দেখা সাধারণত মিলত না। ব্যাস! ঐটুকুই। বাকি সারাদিন উপোষ। রাতেও কোনও খাবার মিলত না। আর খাটনি ছিল হাড়ভাঙা। সূর্যোদয়ের আগেই বন্দিদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হত। তারপর ক্যাম্প থেকে ‘লং মার্চ’। সাধারণত কয়েক মাইল দূরে গন্তব্য। সেখানে হয় যুদ্ধের জন্য বরফ জমা মাটিতে গভীর ট্রেঞ্চ কাটতে হতো, নয়তো রেললাইন পাততে হত। এমনধারা কাজে একাধিক মানুষ নজর রাখত। তারা হয় এসএস বাহিনীর লোক, নয়তো সেইসব বন্দি যাদের ডাকা হত ‘ক্যাপোস’ নামে। এরা হল সাদা বাংলায়, যাদের বলে পাল্টিবাজ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগ্রামীরা যাঁদের রাজাকার বলতেন।
ক্যাপোস এবং এসএস গার্ডরা যখন নজর রাখার বিষয়ে অমনোযোগী হয়ে পড়ত, তখন বন্দিদের একে অপরের মাধ্যমে সেই খবর পৌঁছে যেত একদম শেষের মানুষটির কাছেও। সেই সুযোগে তাঁরা নিজেদের মধ্যে একটু হালকা কথাবার্তায় জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করতেন না। নিজেদের মধ্যে এইসব কথাবার্তা শেষে সেই বিষয়ে পৌঁছোত যখন একজন আর একজনকে মুক্তির পর নিজের বাড়িতে রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করে বসতেন। তারপর কথাবার্তা এগোত কী কী খাওয়ানো হবে সেই পর্যন্ত। শেষে তাঁরা একেবারে ঠিক কী কী পদ পরিবেশন হবে সেই পর্যন্ত চলে যেতেন। অর্ধভুক্ত থাকতে থাকতে, এটুকুই যেন ছিল মানসিক মলম।
এবার চোখ ফেরান সমাজমাধ্যমের পর্দায়। লক্ষ্য করে দেখবেন, আজকাল ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম ভরে গিয়েছে গুটিকয়েক তথাকথিত ‘ফুড ভ্লগার’-এ। তাঁদের তৈরি প্রচুর কনটেন্টে। অপেক্ষাকৃত কমদামে কোথায় খাবার পাওয়া যায় তার গুচ্ছের রিল। কী আছে সেখানে? কারও মতে ১০০ টাকায় বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছে মধ্যমগ্রাম বা ব্যারাকপুরের কোন ফুটপাথের দোকানে, তার সন্ধান। কোথাও ময়দানের কোন ক্লাব ক্যান্টিনে নানা মাছের পদ পাওয়া যায়, তার সন্ধান। কিছু রেস্তোরাঁর সন্ধানও থাকে। নতুন ধরনের ইউরোপীয় পদ, বা বাঙালি পদ উপস্থাপিত করছেন তাঁরা।
এটাকেই দুনিয়া আরেক নামে ডাকে আজকাল। ‘ফুড পর্ন’, এই রিলগুলি আসলে অতি নিম্নমানের ‘ফুড পর্ন’। এই সব রিল নির্মাতাদের বেশিরভাগের না তৈরি হয়েছে জিভ, না আছে স্বাদের কোনও উপলব্ধি। না হলে, এতো অবলীলায় ১০০ বা ১৫০ টাকা প্লেট বিরিয়ানির তুলনা কেউ ভালো বিরিয়ানির সঙ্গে করেন না মূর্খের মতো। এক প্লেট এমন সস্তার বিরিয়ানি এই বাজারে কোনও মতেই কাউকে খাওয়ানো সম্ভব নয়। বাজারে গিয়ে খোঁজ করুন। খাসির মাংস প্রায় ১০০০ টাকা কেজি যাচ্ছে, উচ্চমানের বিরিয়ানির বাসমতী চালের দাম অন্তত ২০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। এর সঙ্গে যোগ করুন বিরিয়ানির মশলা আর জাফরান। কিছু গুঁড়ো মশলা প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘বিরিয়ানি মাসালা’ নামে যেটা বাজারে ছেড়েছে, তার কথা বলছি না। বলছি সঠিক বিরিয়ানির মশলার কথা। যে জিনিস বড়বাজারের গুটিকয়েক মশলার দোকানেই একমাত্র পাওয়া যায়। অন্তত ৬০০ টাকা কেজি, কম করে হলেও। এছাড়াও বিরিয়ানিতে গাওয়া ঘি আর দুধ লাগে। এত কিছু ১০০-১৫০ টাকায় দেওয়া সম্ভব? কিন্তু তাতেও কিছু এসে যাচ্ছে না। সমাজমাধ্যমে দর্শক এই রিলই গিলছেন। কেন? এর কারণ একটাই হতে পারে। তাঁরা কেউই বাড়ির পাতে পড়া পদে তুষ্ট হতে পারছেন না। সেই অতৃপ্ত আত্মা শান্তি খুঁজছে মুর্খামিতে ভরা রিলের চলমান ছবি-কথায়। নিম্নমানের কিন্তু তাতেই মানুষ মজে থাকে।
এটাই ‘প*র্নোগ্রাফির’ প্রকৃতি। নিম্নমান, বিকৃত। মানুষ কখন ‘প*র্নোগ্রাফি’র শরণ নেয়? যখন তার সাধ হয়, কিন্তু সাধ্যে কুলায় না। যে কারণেই ‘প*র্নোগ্রাফি’ এত জনপ্রিয়, হলুদ সেলোফেনে মোড়া বাংলা ‘প*র্নোগ্রাফি’ উপন্যাস বা ‘বটতলা বই’ এক সময়ে এসপ্ল্যনেডের রক্সি সিনেমা থেকে এসএন ব্যানার্জি রোডের বাঁদিকের ফুটপাথে লাইন দিয়ে বিক্রি হত. তাতে যা লেখা থাকত, তা বিকৃত, অশ্লীল এবং অসামাজিক যৌনাচারের কথা। তার ক্রেতা ছিল ঘরে ঘরে। সেটাই সত্য। ‘ফুড পর্ন’ তার থেকে কিছুমাত্র ভিন্ন নয়। কিন্তু তার দর্শক এখন ঘরে-ঘরে।
এটা কখনও ভেবে দেখেছেন কলকাতার মতো এক আদ্যোপান্ত বাঙালি শহরে এত বাঙালি রান্নার রেস্তোরাঁ কী কারণে? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, বাঙালি আজকাল নিজেদের বহু শতক ধরে জানা রন্ধনশিল্পকে সম্ভবত ভুলে দিয়েছে। '৬০ '৭০, ‘৮০-র দশক পর্যন্ত বাঙালির হেঁশেল ছিল তার একমাত্র খাদ্য পরিগ্রহণের গর্ভগৃহ। ’৬০-এর দশক পর্যন্ত বাঙালি যৌথ পরিবারে ১০-২০ জনের পাত পাড়া কোনও সমস্যা ছিল না। ‘বাওয়ার্চি’ বা তার আগে তপন সিংহের ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’ সে কাহিনিই দেখায়। সে সময়ের গৃহ হেঁশেল সামলাতেন বাড়ির মহিলা সদস্যরা। কিন্তু বাঙালি মহিলারা কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ‘৬০-এর দশক থেকে। বেশিরভাগই সে সময়ে স্কুলের শিক্ষিকার পেশায় নিজেদের নিযুক্ত করলেন। আর এখন তো তাঁদের কেউ শিক্ষক, কেউ চাকুরে, কেউ চিকিৎসক, কেউ আইনজীবী, কেউ গবেষণায় রত, কেউ আরও অন্য কোনও পেশায়। ভারতীয় নারী এই মুহূর্তে বিশ্বের নারী স্বাধীনতার প্রতীক। সে আর শুধুমাত্র গৃহবধূ নয়। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, সেটি নারীসম্মানের নিরিখে বিশ্ব মূল্যায়ণে সমতূল। কিন্তু এর ফলেই মূলত মৃত্যু হল বাঙালি রন্ধনশিল্পের। বাঙালি পুরুষ, ঐতিহাসিকভাবে কখনও রান্নাঘরে ঢোকেনি। তাকে ভালমন্দ খাওয়ানোর কাজ বাঙালি নারী নিজের দ্বায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছে যুগ-যুগ ধরে। অবিবাহিত থাকলে, বা বিপত্নীক হলে, পুরুষকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য একজন ‘রান্নার লোক’ রাখার রেওয়াজ ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’ ছবির প্রথম কাহিনি রবিঠাকুরের একই নামের ছোট গল্প। ‘পোস্টমাস্টার’-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি। লেখা হয়েছিল ১৮৯১ সালে, সত্যজিতের ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬১ সালে। ছবির প্রধান চরিত্র নরেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে এক অজ পাড়াগাঁয়ের পোস্টাপিসের আধিকারিক হয়ে আসে। এহেন জায়গায় তাকে রান্না এবং ঘরকন্না করতে সাহায্য করার জন্য নিযুক্ত হল বাপ-মা, স্বজনহীন রতন। একটি বাচ্চা মেয়ে। লক্ষ্য করুন, এইসব ঘরের কাজের জন্য একজন পুরুষ বেতনভিত্তিক পেটচুক্তিতে নিয়োগ করছে এক মেয়েকে, অর্থাৎ নারীকে। মানে সে যেহেতু পুরুষ তাই সে একাজগুলি করতে অপারগ। বাঙালি পুরুষের দৈনিক রান্নায় একমাত্র অবদান হল ওই দৈনিক বাজারটুকু সকালবেলা করে দেওয়া। বাকিটা বাড়ির মহিলারা করবেন। কারণ? আমি ছোটবেলায় আমার ঠাকুমার মুখে শুনেছি, ‘সে আবার কী কথা! বাড়ির মেয়েরা বাজারে যাবে মানে? জোয়ানমদ্দদের ভিড়ে মেয়েছেলে দরদাম করবে! জম্মেও শুনিনি বাবা...’ এই সব রান্নাবান্না, গৃহকর্মের জন্য নিযুক্ত মহিলাদের তখনকার দিনে ডাকা হতো ‘ঝি’ নামে। পরে অবশ্য তাতে সামান্য শহরসুলভ ভদ্রতার প্রলেপ দিয়ে সম্বোধনটি ‘কাজের লোক’ হিসাবে পরিচিতি পায়।
সেই সব ঝিদের তদারকির ভার ছিল পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদের উপর। তাঁদের অবর্তমানে বা অনুপস্থিতিতে যে মহিলা সংসারের ভার নিতেন, তাঁর উপর। মোদ্দা কথা, পুরুষদের রান্নাঘরের সঙ্গে কোনওই সম্পর্ক ছিল না। সেই সব রান্নাঘরে চলত নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কোন মশলার সঙ্গে কোন মশলা মেশালে কী রকম স্বাদ হবে, রান্নার জন্য কোন তেল ব্যবহার করা উচিত, বাটনা কীভাবে বাটতে হবে, মাছের কোন অংশ খাওয়া যায়, কোনটা যায় না, পাঁঠার মাংস কতটা সিদ্ধ হলে নরম হবে, ভাত কোন চালে তৈরি হবে, ইত্যাদি নানাবিধ রীতিমতো বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক। একই সঙ্গে পুরুষদের রোজগারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোন জিনিসটা কত দামের, আর সংসার খরচ কতটা বাঁচানো যাবে তারও হিসাবনিকাশ। অর্থাৎ রসায়ন ও মৌলিক অর্থনীতির ফলিত হিসাব।
এই সব জ্ঞান ‘৬০-এর দশকের শেষ থেকে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল। কারণ বাড়ির মহিলারা ধীরে-ধীরে বাইরের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলেন। তাঁদের হাতে গৃহকোণে লালিত এই সব জ্ঞান আরহণের সময় আর থাকল না। গড়ে ছয় থেকে আট ঘণ্টা শ্রম দিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর আর কখনই বা ক্লান্ত মস্তিস্ককে এইসব গৃহলালিত জ্ঞানের পিছনে খাটানো যায়?
এর পর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করলেন দিনে-দিনে। তাঁদের সঙ্গে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল সেইসব জ্ঞান যা তাঁরাই আবিষ্কার করেছিলেন। এমন একটা সময় এল, যখন এইসব শিক্ষাগুরুরা আর কেউ জীবিত রইলেন না। হারিয়ে গেল মোচার ঘন্ট, পোস্তর তরকারি বা বড়া, বিউলির ডালের বড়া, ছানার বড়ার তরকারি, বা নেহাতই পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া, স্রেফ আদাবাটা, জিরেবাটা, গোটা গরম মশলা আর ঘি দিয়ে নিরামিষ মাংস রান্নার পদ্ধতি। বা শিল-নোড়ার ব্যবহার। কতগুলি বাঙালি বাড়িতে আজ শিল-নোড়া ব্যবহার হয়, বা তা যে কাটাতে হয় সময়ে-সময়ে, সেই জ্ঞান থাকা সভ্য বর্তমান, তা হয়তো হাতের কর গুণলে পাওয়া যাবে। আর বাটা-গুঁড়োর জন্য তো মিক্সার-গ্রাইন্ডার আছেই। কিন্তু পদগুলো যে হারিয়ে গেলো! অথচ বাঙালি নোলা পাল্টানো গেলো না সহজে। তা যে আজ চায় সেইসব স্মৃতিস্বাদ পেতে। ব্যাস! তৈরি হয়ে গেল ‘অথেন্টিক’ বাঙালি রেস্তোরাঁর বাঁধা খদ্দেরের দল। কারণ বাড়িতে যে রান্না আসছে বা হচ্ছে, তাতে বাঙালি জিভের স্বাদপ্রবৃত্তি মিটছে না। কোথায় শান্তিনিকেতন স্টেশন রোডের কোন ভাতের হোটেলে ভালো পোস্তর বড়া তৈরি করে, তার খবর জোগাড় করা হচ্ছে। পেট্রোল পুড়িয়ে উজিয়ে সেখানে পৌঁছে পোস্তর বড়ার স্বাদ নিয়ে তবে শান্তি! কলকাতার কোন রেস্তরাঁয় মোচার ঘণ্ট বা আলুপোস্ত পাওয়া যায় সেখানে ভিড় জমাচ্ছে বাঙালি। ভাবুন কী নিদারুণ করুণ অবস্থা আধুনিক কর্পোরেট বাঙালির। যা তার বাপ-ঠাকুর্দা ঘরে বসে এক হাঁকে পেয়ে যেতেন এক সময়ে, তার জন্য কতটা অর্থ, কী প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হচ্ছে আধুনিক বাঙালিকে।
এটাই কি ফ্র্যাঙ্কলন বর্ণিত ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’-এ বন্দিদের মানসিকতা নয়? তাঁরা খেতে পেতেন না, দিনের পর দিন কাটত জোলো স্যুপ আর সামান্য পাঁউরুটি খেয়ে, আর স্বপ্নের জাল বুনতেন বাড়িতে ফায়ার ভালো-মন্দ খেতে পাওয়ার। আর আজকের বাঙালি খেতে পেয়েও তুষ্ট হচ্ছেন না। তাঁর স্মৃতি মজে আছে এমন কিছু স্বাদে, এমন কিছু পদে, যার জন্য তাঁরা খরচ এবং পরিশ্রম– দুইই করতে রাজি। বলা যায় রীতিমতো বাধ্য।
এই মারণ-ভূমির মানসিকতা কি কাটানো যেত না? অবশ্যই যেত। যদি বাঙালি পুরুষ একটু আলস্য ভুলে রান্নাঘরে খানিক সময় ব্যয় করতেন। বাড়ির মেয়েটা বাইরে যাচ্ছে, কিন্তু তিনিও তো রান্নাঘরের চৌকাঠটুকু পেরোতে পারতেন। পারলেন না দু’টি কারণে। পুরুষোচিত আলস্য আর বরাবরের অদূরদর্শিতা। আজ নোলা সকসক করছে, তাই এই পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করতে হছে। কৃতকর্মের ফল। একেই বোধহয় বলে, ‘অতি লোভে, তাঁতি নষ্ট’।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত