পরমা দাশগুপ্ত, সাংবাদিক
‘যারা ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়ায়...’
বাকিটা আশা করি বলতে হবে না? গত দিন তিনেকে এই শব্দবন্ধ তথা বক্তব্য ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। যার কেন্দ্রে প্রবীণ অভ♎িনেত্রী🌱-নৃত্যশিল্পী মমতাশঙ্কর।
একটি শꦺাড়ির প্রদর্শনীতে এখনকার প্রজন্মের সাজের ভাবনা নিয়ে তাঁর মতামত চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে সেই সংবাদমাধ্যমকে তিনি যা বলেছিলেন, তার সারবত্তা হল, একালের মেয়েদের শাড়ি পরার ধরনে তিনি শালীনতার অভাব বোধ করছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি তুলনা টেনেছেন সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির সঙ্গে। সেই নারীদের পেশার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টা মমতাশঙ্কর যে ভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে🍬 মানেটা দাঁড়ায় পোশাকই মেয়েদের চরিত্রের মাপকাঠি, আঁচলের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-অবস্থানেই শালীনতা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। এবং হ্যাঁ, তা নিঃসন্দেহে অপমানজনক। নারীপ্রগতির যুগে দাঁড়িয়েও কেউ এভাবে ভাবলে তা থেকে পুরুষতন্ত্রেরই নখদাঁত বেরিয়ে আসে।
ফল যা ⭕হওয়ার তা-ই। এক দল যখন প্রবীণ অভিনেত্রীর সুরে সুর মিলিয়েছেন🌃, আর এক দল রে রে করে তেড়ে গিয়েছেন তাঁর দিকে। শানিত প্রতিবাদে গত তিন দিন সোশ্যাল মিডিয়া বানভাসি। এবং এমনটাও হওয়ারই কথা ছিল। কারণ মমতাশঙ্কর কথা বলেছেন জনসমক্ষে।
তবু সব দেখেশুনে একটা বিষয় ভীষণ রকম ভাবাচ্ছে। প্রবীণ অভিনেত্রী নিজে লোক ডেকে কিছু বলতে যাননি। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। উত্তরে তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেছেন। মমতাশঙ্কর তারকা, বলেছেন জনসমক্ষে এবং যা বলেছেন তা অপমানজনক- এই সমস্তটা মেনে নেওয়ার পরেও যেটা পড়ে থাকে, তা হল তাঁর বাকস্বাধীনতা। মেয়েরা কী ভাবে শাড়ি পরবে, সেটা যেমন তিনি ঠিক কর🐲ে দেওয়ার কেউ নন, তেমনই তিনি কী ভাববেন,কী বিশ্বাস করবেন, সেটা কি অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে? আমরা একালের মেয়েরা নারীপ্রগতিকে যে ভাবে দেখি, তাঁকেও সে ভাবেই দেখতে হবে-- সেটাও কি আমরা ঠিক করে দিতে পারি?
এখানে আরও একটা জিনিস খেয়াল রাখা জরুরি। মমতাশঙ্কর যে বয়স বা যে প্রজন্মের মানুষ, তখনকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁকে এভাবেই ভাবতে, বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে। ঠিক যেভাবে আমরা এযুগে দাঁড়িয়ে নারীপ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়নে আস্থা রাখতে অভ্যস্ত হয়েছি। এই দুটো ভাবনার কোনটা ঠিক, কোনটাই বা বেౠঠিক, সেটা ঠিক করার আমি কেউ নই। কিন্তু💎 আমার-আপনার চারপাশে মমতাশঙ্করের বয়সী মহিলাদের একটা বড় অংশই কি একই ভাবে ভাবেন না? তাঁদেরও কি এ ভাবে হেনস্থা হতে হয় রোজ? অভিনেত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে একাধিক ফেসবুক পোস্টে একটা কথা চোখে পড়ছে- ‘মা-মাসিদের মতো কথা’। মূলত যে লাইনটায় আপত্তি উঠেছিল, ‘যারা ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়ায়’, তা সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণিকে চিহ্নিত করে অপমানের সামিল। কিন্তু এই ‘মা-মাসিদের মতো কথা’ ব্যাপারটাও খানিক একই সুরেই তো বাজল। আমরা আলাদা, মা-মাসিরা আলাদা শ্রেণি। যাঁদের কথা হেয় করাই যায়। এমনই খানিকটা শোনাল না কথাটা? কেউ কেউ লিখছেন বা বলছেন, মমতাশঙ্কর এবং তাঁর বক্তব্য সমর্থন করছেন যাঁরা, তাঁরা সবাই মিলে এখনকার শাড়ি পরার ধরন নিয়ে রীতিমতো খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এই যে প্রতিবাদী পোস্টের ঢেউ, তাতে স্রেফ এখনকার ধ্যানধারণার সঙ্গে মতের মিল নেই বলেই মমতাশঙ্করকে ঘিরে যে ধরনের কথাবার্তা চোখে পড়ছে, তা-ও কি প্রকারান্তরে খাপ পঞ্চায়েত নয়?
আর🅠 সবচেয়ে উদ্বেগের যে বিষয়টা, তা হল ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্রেফ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজস্ব মতামত দেওয়ার অপরাধে কাউকে এভাবে লাগাতার তুলোধনা করে যাওয়া। প্রগতিশীলতা বা উদারমনস্কতা তো বলে একটা সমাজে সব ধরনের মানুষ, সব মতে🌳র, সব ধর্মের, সব কর্মের মানুষ একসঙ্গে, শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকুক। তা হলে কেন আমার মতের সঙ্গে কারও মত মিলল না বলে তাঁকে সবাই মিলে একঘরে করে ফেলতে হবে, পারলে তাঁকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলার জোগাড় করতে হবে? হ্যাঁ সর্বসমক্ষে বলা কারও ব্যক্তিগত মতামত অপমানজনক, অসম্মানজনক হলে তার প্রতিবাদ করাটাও নিঃসন্দেহে যাঁর যাঁর স্বাধীনতা। কিন্তু প্রতিবাদের নামে কারও জীবন, শিক্ষাদীক্ষা, রুচি, পরিবার, সমাজে তাঁর অবদান, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবটাতে দেদার কাদা ছেটাতে থাকাটা কি সত্যিই খুব জরুরি? প্রগতিশীলতা কি এমনটাও শেখায়? প্রতিবাদ করতে হলে তাতে কিছুটা মাত্রাজ্ঞান থাকাটাও জরুরি নয় কি?
না, মমতাশঙ্কর যা বলেছেন, যে ভাবে বলেছেন, তা একেবারেই সমর্থন করতে পারিনি আমিও। কিন্তু যেটা এড়িয়ে যেতে পারিনি, তা হল ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টা। আমার মতের সঙ্গে মিলছে না বলেই কেউ ভুল এবং তাঁকে নিজেকে শোধরাতেই হবে, এটা কী রকম দাবি? শাড়ি পরার ধরনটা যেমন যাঁর যাঁর নিজস্ব পছন্দ এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন, তে🅠মনই কারও ব্যক্তিগত মতামতও তো তাঁর নিজস্ব পছন্দ এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন।
নিজের ফেসবুক পোস্টে ঠিক এই প্রশ্নটাই তুলেছিলাম। ꦉতাতে সমর্থন যেমন এসেছে, তেমনই꧃ প্রতিবাদও এসেছে। তবু আরও এক বার ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। ভিন্নমতকেও সম্মান করা এবং তার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কি খুব কঠিন?
(মতামত ব্যক্তিগত)