সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এখনও বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা'র সঙ্গে সময় কাটানোর কথা ছিল তাঁর। কিন্তু লকডাউনের জেরে লাদাখেই আটকে পড়েছিলেন। করোনাাভাইরাসের প্রকোপ কাটলে সেপ্টেম্বরে বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণের আগে গালোয়ান সংঘর্ষে মারা গেলেন কর্নেল বি সন্তোষ বাবু (৩৭)। তেলাঙ্গানার সুরিয়াপেটের শেষবারের মতো বুধবার যখন তিনি আসবেন, তখন তিনি নিথর। তখন তিনি দেশের শহিদ কর্নেল।তাঁর কাকা বলেন, 'অনেকদিন ধরেই ও হায়দরাবাদে বদলির চেষ্টা করছিল এবং গত ফেব্রুয়ারিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল থেকে কর্নেল পদে উন্নতির পর অনুমোদন মিলেছিল। কিন্তু বদলির প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই দেশে লকডাউনের ঘোষণা করে কেন্দ্র এবং পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ওকে লাদাখে ভারত-চিন সীমান্তে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।'সুরিয়াপেটের বাড়িতে বসে মঙ্গলবার সকাল থেকেই গালওয়ান উপত্যকায় ভারত এবং চিন সেনার সংঘর্ষের খবর জানতে পারেন শহিদ কর্নেলের বাবা-মা। শহিদ জওয়ানদের নাম উল্লেখ না করায় খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না তাঁরা। কিন্তু দুপুর দুটো নাগাদ বৌমার ফোনে এক লহমায় বদলে যায় বাবা বি উপেন্দ্র (৬৩) এবং মঞ্জুলাদেবীর (৫৮) দুনিয়া। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক বি উপেন্দ্র বলেন, 'টেলিভিশনে ভারতীয় এবং চিনা সেনার মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষের খবর দেখছিলাম। তবে কোনও নাম উল্লেখ না করা হওয়ায়, আমরা কখনও ভাবিনি নিহতদের মধ্যে আমাদের ছেলেও থাকবে। যখন আমরা দিল্লি থেকে বৌমার ফোন পাই, তখন বুঝতে পারি, আমাদের ছেলে শহিদ হয়েছে।' বি সন্তোষের স্ত্রী সন্তোষী, মেয়ে অভিগ্না (৯) এবং ছেলে অনিরুদ্ধ (৪) দিল্লিতে থাকেন। শহিদ কর্নেলের বাবা বলেন, 'আমার সঙ্গে মাত্র দু'দিন আগেই কথা বলল। জানাল, করোনাভাইরাস মহামারী একেবার কমে গেলে আগামী সেপ্টেম্বরে ওকে (লাদাখ থেকে) ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু ও আমাদের ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে গেল।'ছেলে হারানোর শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন কর্নেলের বাবা। যাঁর থেকে সেনায় যোগ দেওয়ার স্বপ্ন পেয়েছিলেন বি সন্তোষ বাবু। বি উপেন্দ্র জানান, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাঁর সেনায় যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল। পারিপার্শ্বিক চাপে তা সম্ভব না হলেও বাবার স্বপ্নের সওয়ারি হয়েছিলেন শহিদ কর্নেল। সূর্যপেটে প্রাথমিক স্কুলে পড়ার পর অন্ধ্রপ্রদেশের বিজিয়নগরম জেলার কোরকুকোন্ডায় সৈনিক স্কুলে ভরতি হয়েছিলেন। যে স্কুলটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে রয়েছে। সেখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পুণেতে ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে যোগ দিয়েছিলেন বি সন্তোষ বাবু। তারপর দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৪ সালে ১৬ বিহার রেজিমেন্টে কমিশনড হয়েছিলেন। প্রথম পোস্টিং ছিল জম্মুতে। তারপর বিভিন্ন প্রান্তের সীমান্তে মোতায়েন ছিলেন। শহিদ কর্নেলের বাবা বলেন, 'পড়াশোনা এবং চাকরি দু'জায়গাতেই দুর্দান্ত ছিল ও। আমি কখনও ভাবিনি. ও আমাদের এভাবে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ায় গর্বিত আমি।' বুকে কষ্ট চেপে একই কথা বললেন শহিদ কর্নেলের মা। তিনি বলেন, 'আমি হতবাক। কিন্তু আমি ছেলের জন্য গর্বও বোধ করছি যে দেশের সেবায় নিজের প্রাণ নিয়োজিত করেছে।' স্বামীর থেকে অনেক বেশি শান্ত ছিলেন মঞ্জুলাদেবী। যেন নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, তিনি একজন কর্নেলের মা।বুধবার সকাল সাড়ে ন'টা নাগাদ শহিদ কর্নেলের দেহ হায়দরাবাদে নিয়ে আসা হবে। সেখান থেকে সোজা সুরিয়াপেটে শেষকৃত্যের জন্য দেহ নিয়ে যাওয়া হবে।