ইমন মিত্র
সমসময়ের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলেই এক ধরনের ঔচিত্যবোধ আমাদের গ্রাস করে। রাজনীতির কোন পথটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা নয়, সেটা নিয়ে আমাদের নিজেদের যে বিশ্বাস তাই সার্বভৌম হয়ে যায়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়🤡ে নানা মত উঠে আসছে। প্রায় সব মতেই এই ঔচিত্য🌌বোধের প্রাবল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এই সময়ে সেটাই স্বাভাবিক। ইতিহাসের এক ঘূর্ণাবর্তে আমরা এখন আটকে আছি। দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা হবেই। আর সেই ভাবনাকে একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ দেয়ার জন্য উচিত-অনুচিতের ফারাক করা প্রয়োজন তো বটেই।
আমরা যারা ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের চর্꧙চা করি, তাদের জন্য এই সময়টা মুশকিলের। এই প্রবল উত্তরাধুনিক সময়েও পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণের দায় থেকে যায়। কিন্তু যে বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু আপাতত ভবিষ্যতের কালগর্ভে, সে নিয়ে কথা বলতে গেলে নানারকম জল্পনাভিত্তিক গোঁজামিল এসেই যাবে। পক্ষপাতের অভিযোগও উঠবে। এই সমস্যার কোনও চটজলদি সমাধান নেই। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ বলে কিছু হয় না, এটা বলে দেওয়া সহজ। কিন্তু তাতে আদতে ক্ষতি কার, সেটা আমরা আজকাল ভালোই টের পাচ্ছি। মাঝামাঝি একটা অবস্থান নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। নানা পক্ষপাত (ব্যক্তিগত, আদর্শগত, অভিজ্ঞতা প্রসূত) বিশ্লেষণে ছায়া ফেলবে। কিন্তু তাকে অস্বীকার না করে, বরং তা বিশ্লেষণকে কীভাবে প্রভাবিত করছে খেয়াল রাখা ও তাকেও বিশ্লেষণের আওতায় আনা জরুরি।
শুনতে সোজা লাগলেও, কাজটা বেশ কঠিন। এই মুহূর্তে যেমন গত এক মাসের ঘটনাক্রমকে বিভিন্ন মানুষ নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। এই ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে কোনটাকে আমরা গ্রহণ করব, তা নির্ভর করবে আমাদের পরিচিতি ও অবস্থানের স্থানাঙ্কের উপর। আমরা প্রায় সবাই এඣই স্থানাঙ্কগুলো সম্বন্ধে মোটামুটি অবহিত; বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতির প্রেক্ষিতে আমাদের নিজেদের অবস্থানের জটিলতা আমাদের বোধগম্য নয়, এমনটা নয়। তবুও আমরা কিছুটা অজান্তে এবং কিছুটা জেনেবুঝেই এমন সব ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করে সামাজিক মাধ্যমে লড়ে যাচ্ছি, যা সেই জটিলতাকে অস্বীকার করে নানা বাইনারি বা দ্বিত্বের বাইরে ভাবনাকে বেরোতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক পালাবদল কিন্তু বারবার এই দ্বিত্বের বাইরে বেরোবার আহ্বান জানিয়েছে। তবে আমাদের চিন্তার এই অনমনীয়তা কেন?
একটা কারণ কী এই যে আমাদের পরিচিত বাঙালিত্বের ধারণাটাকে আমরা সারাক্ষণ গোটা বিশ্বের বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি? এবং যখন সেই ধারণার পক্ষে অস্বস্তিকর কিছু আমাদের চোখে পড়ে, তাকে বিজাতীয় ও আপত্তিকর বলে দাগিয়ে দিতে চাই? পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিত্বের এই ধারণাটা মূলত গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক সময়ে কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে, তথাকথিত বঙ্গীয় নবজাগরণের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবে। নবজাগরণের এই ইতিহাসের সঙ্গে শৈশব থেকেই আমাদের পরিচয় কিছু মনীষীর সংক্ষেপিত জীবনবৃত্তান্তের মাধ্যমে। তাঁদের ভাবনাচিন্তা ও কর্মের বিস্তৃতি ও সেগুলোর নানা অসঙ্গতির কথা স্বাভাবিক ভাবেই এই জীবনীমূলক শিক্ষার অন্তর্গত নয়। ফলে বিভিন্ন মনীষীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ‘সেই সময়’-এর প্রতি প্রশ্নাতীত সম্ভ্রম ও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত এক ইতিহাসবোধ নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। ভুলে 🌱যাই এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষ এই ইতিহাসের অংশ কোনওদিন হতে পারেননি শুধু না, তাঁদের অনুপস্থিতি বা বহিষ্কারই এই ইতিহাসের পারম্পর্য রক্ষা করছে।
এই ইতিহাসে বহিষ্কৃত জনগোষ্ঠী যখন তাদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়, সেই ভঙ্গী আমাদের কাছে বিসদৃশ ঠেকে, কারণ তাদের ‘অমার্জিত’ উচ্চারণ ও অঙ্গভঙ্গি আমাদের সযত্নে লালিত প্রমিত ইতিহাসের সঙ্গে খাপ খায় না। এই কারণেই চল্লিশ বছর আগে কিছু ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের এই মার্জিত রক্ষণশীলতার প্রতি প্রশ্ন তুলে নিম্নবর্গের ইতিহাসের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। যদিও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নবর্গের ইতিহাস আজকাল পাঠ্যসূচীর অন্তর্গত, কিন্তু তা যে বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে, তা প্রায়শই বোঝা যায় সামাজিক নানা ⛎বৈষম্যের প্রসঙ্গ উঠলে। রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা এখানে এক আশ্চর্য কুয়াশায় ঢাকা। এই কুয়াশার নাম সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
যে ঔচিত্যবোধের চশমা দিয়ে আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে দেখছি তা এই শুদ্ধ সাংস্কৃতি🥂ক ইতিহাসের উত্তরাধিকার, যা আমাদের আশ্বস্ত করেছে রাজনীতিতে হিংসার কোনও স্থান নেই। অথচ অতীতের কথা যদি বাদও দিই, আমাদের সমসময়েও রাজনৈতিক পালাবদল শাসক ও শাসিতের মধ্যে হিংসাশ্রয়ী দ্বন্দ্ব ছাড়া কল্পনা করা অসম্ভব। পৃথিবীর কোথাওই তা হয় না। এই দ্বন্দ্বে প্রগতিশীলতার পাশাপাশি নানা রক্ষণশীল শক্তিও কার্যকর থাকে দুই পক্ষেই। তার ফলে যাঁরা প্রগতির পক্ষে, তাঁদের জন্য এ এক কঠিন লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে জনতার বহুস্বরকে মান্যতা দিতে হবে, অন্যদিকে নিজের আদর্শিক অবস্থানকেও তুলে ধরতে হবে। এই টানাপোড়েনে অনেক সময়েই বিশ্লেষণে ভুল হয়ে যায়, যা প্রাথমিকভাবে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন মনে হয়েছিল, তাকেই হঠাৎ রক্ষণশীলতার চক্রান্ত মনে হতে থাকে। এই দুই ভাবনার মধ্যে কোনটা ঠিক, তা আন্দোলন চলাকালীন বোঝা দুষ্কর। পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই তা এত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করে ফেলা যায়নি। অতএব সময়ের দাবি মেনে চিন্তাশীল মানুষ তাঁর কর্মপদ্ধতি ঠিক করবেন, এটাই কাম্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি এত তাড়াতাড়ি বোঝা না গেলেও একটা ব্যাপার স্পষ্ট। আগের আন্দোলনগুলোর থেকে এই আন্দোলন আলাদা ছাত্রদের বিশাল সংখ্যায় যোগদানের জন্য শুধু নয়। ছাত্ররা এর আগেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। এবারের আন্দোলনে দুটো জিনিস উঠে এসেছে যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়বাদী রাজনীতির (popular politics) বৈশিষ্ট্য। ছাত্ররা নিজেদের একটা নির্দিষ্ট প্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছে (জেন জি, gen z) যা আগের প্রজন্মের দ্বারা প্রতারিত বোধ করে ও সেই আশাভঙ্গের প্রতিবাদꦜে নিজেদের সংগঠিত করে। দুই, সামাজিক মাধ্যমের কুশলী ব্যবহার যা আন্দোলনকে দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে দিতে সাহ🅷ায্য করেছে ও আন্দোলনকারী ও সমর্থক জনতার মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করেছে।
এই সহস্রাব্দের শুরু থেকে একদিকে ইন্টারনেটের প্র𝔉সার ও সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি নানা দেশে ছাত্র ও যুবাদের বিক্ষোভ, আন্দোলন দেখা গেছে। কিছু দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও হয়েছে। বাংলাদেশেই বছর দশেক আগে শাহবাগ আন্দোলনের সময় এর ভূমিকা বোঝা গিয়েছিল। সেখানেও আন্দোলনকারীদের পক্ষে সহায় হয়েছিল সমাজমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা। মূলধারার সংবাদমাধ্যম যখন সরকারি ব্যবস্থার গুণগান গাইতে ব্যস্ত, নানা অনলাইন ফোরাম ও টেলিগ্রামের মতো নতুন যোগাযোগ মাধ্যম বিক🌜্ষোভের আগুনকে জিইয়ে রাখে। স্বৈরাচারী সরকার তখন চায় ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর নিয়ন্ত্রণ। নানা সুরক্ষা আইন পাশ হয়। এমনকী আন্দোলনকে রুখতে পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ারও আদেশ হয়। অনেকে এখনও মনে করেন এই মাধ্যমগুলো আসলে মনোরঞ্জনের উপকরণ। ধীরে ধীরে এগুলো যে সাধারণ মানুষের জীবিকা অর্জনের সাধন হয়ে উঠেছে, তার হদিশ তারা রাখেন না। ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যহত হলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকায় টান পড়ে। তখন তাঁরা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বেশি, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অগ্রগণ্য। সরকারি সংবাদমাধ্যম যখন মানুষের ক্ষোভের থেকে মুখ ঘুরিয়েছে, অনলাইন ফোরামগুলোতে সেই ক্ষোভ প্রবলতর হয়ে আছড়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামি লিগ নেতৃত্ব তাঁদের প্রতি মানুষের অনাস্থায় হতচকিত হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু ফেসবুক বা টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা নিয়মিত, তাঁদের কাছে এই ঘটনা খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। মানুষের ক্ষোভ জনতার রোষে পরিণত হয়েছে যখন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে সরকার ভেবেছিল আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যাবে। উপার্♒জনের রাস্তা বন্ধ করে ছাত্রদের আন্দোলনকে সরকারই জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
ইন্টারনেট ও সমাজ মাধ্যমের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রাচীনপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে এখনও কতটা স্পষ্ট, সন্দেহ আছে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের নজরদারি আর বাকস্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণের নিরিখে এই মাধ্যমকে বোঝা যাবে না। এই পরিসরে জনআন্দোলনের সংজ্ঞাও পাল্টে গিয়েছে। প্রগতিশীল লিবারাল রাজনীতির নেতৃꦿত্ববাদী পরিকাঠামো নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের রোজকার সমস্যা নানা বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ও তার সমালোচকদের আরও মনোযোগী হতে হ𒉰বে মানুষের নতুন নতুন ব্যক্তিগত ও সামূহিক চাহিদার প্রতি। বাংলাদেশের এবারের রাজনৈতিক পালাবদল তাই আমাদের সবার কাছে একটা বড় শিক্ষার সুযোগ নিয়ে এসেছে। এর কতটা কী কাজে লাগাতে পারা যাবে, তা সময় বলবে।
(লেখক সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, শিব নাডার বিশ্ববিদ্যালয়। মতামত ব্যক্তিগত)