জীবজগৎ ও প্রকৃতি বলতে আমরা এককথায় উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, ভূতত্ত্ব এইসব বিষয়গুলিকে বুঝি, কিন্তু তড়িৎপ্রবাহ ও ইলেক্ট্রনিক্স? সেগুলিও তো পদার্থবিদ্যার শাখা। তাহলে জীবজগৎ ও প্রকৃতির সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি ও ইলেকট্রনিক্সের মেলবন্ধন ঘটানো কি সম্ভব? ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইলেকট্রনিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ প্রিয়দর্শী মজুমদার ও সন্দীপ দে এবং ওড়িশার জগৎসিংপুরের সি.এন.সি.বি. অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির পদার্থবিদ্যা বিভাগের 🌳অধ্যাপক ডঃ শুভেন্দু পণ্ডা বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানালেন।
তাঁরা জানিয়েছেন, কোনও জৈব বস্তু (উদ্ভিদ বা প্রাণী) তড়িৎ প্রবাহের উৎস হিসেবে তখনই কাজ করবে যদি সেটি নিজে বহু সংখ্যায় ইলেকট্রন দান করতে পারবে। কারণ তড়িৎ প্রবাহ আসলে ইলেকট্রনেরই বিপরীতগামী স্রোত। রসায়নের নিয়ম অনুযায়ী, অম্লধর্মী যে কোনও পদার্থই বহুল মাত্রায় ইলেকট্রন ত্যাগ করতে চায়। ঠিক এই কারণেই অম্লধর্মী বিবিধ উদ্ভিদ জৈব-তড়িৎপ্রবাহের উৎস হিসেবে কাজ করতেই পারে। আপেল, পাতিলেবু, আঙুর, আনারস, কমলালেবু, টমেটো এই সব আম্লিক ফলগুলির জুস তৈরি করে তড়িৎদ্বার আছে, এমন কোনও তড়িৎকোষে ঢেলে দি🔴লে দেখা যাবে যে কোষটি কিছু সময়ের জন্য কমবেশি তড়িৎপ্রবাহ দিচ্ছে।
অবশ্য সবথেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভালো মানের তড়িৎপ্রবাহ পাওয়া যায় পাথরকুচি পাতার রস ব্যবহার করলে। বাংলাদেশে যা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। পাথরকুচি পাতার রস দিয়ে তৈরি তড়িৎকোষ ব্যবহার করে গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় তড়িৎপ্রবাহ ও বিভবপ্রভেদ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশཧের বিজ্ঞানীরা। আমাদের দেশেও সাম্প্রতিক কালে ডিমের খোলা বা কাঁকড়ার খোল থেকে বিদ্যুৎ তৈরি সংক্রান্ত গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। আশা করা যায়, এই বিকল্প পদ্ধতিগুলি নতুন চাকরিক্ষেত্র ও স্বনিযুক্তির জায়গা তৈরি করবে এবং তরুণ বিজ্ঞানীদের আরও নতুন-নতুন জৈব-তড়িৎপ্রবাহের উৎস খোঁজার দিকে উৎসাহিত করবে। কারণ বিকল্প শক্তি অন্বেষণের খুবই প্রয়োজন। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর প্রচলিত শক্🎃তির ভাণ্ডার ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
জৈব-তড়িৎপ্রবাহেরই আরও উন্নত রূপ হল জৈব-ইলেকট্রনিক্স। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ভৌতরাশিগুলিকে (যেমন - শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপের মান, রক্তে শর্করার পরিমাণে সরাসরি ইলেকট্রনিক রাশিতে (বিভ𒁏ব🐷প্রভেদ) পরিবর্তন করা হয়, এই কাজটি যে করে তার পোশাকি নাম ইলেকট্রনিক সেন্সর। বস্তুত জীবজগৎ ও প্রকৃতির সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক্সের মেলবন্ধনের কাজটি করে এই সেন্সর।
সেন্সর আসলে একটি বিশেষ ধরণের ট্রান্সডিউসার। আমরা স্কুলে পড়েছি, শক্তির বিনাশ বা সৃষ্টি করা যায় না। শুধু এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন করা যায়। সেই কাজটিই করে এই ট্রান্সডিউসার। যে ট্রান্সডিউসার অন্য শক্তিকে তড়িৎশক্তিতে বা ভোল্টেজে 🐲রূপান্তরিত করে সেগুলিই হল সেন্সর। নতুন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আবিষ্কার করতে গেলে বিবিধ ইলেকট্রনিক সেন্সরের কার্যকারিতা বোঝা খুবই প্রয়োজন। উষ্ণতা-মাপক সেন্সর, স্পর্শ-সেন্সর, আর্দ্রতা-মাপক সেন্সর, চাপ-মাপক সেন্সর, ইনফ্রারেড সেন্সর, তল-মাপক সেন্সর, দূরত্ব-মাপক সেন্সর, আল্ট্রাসনিক সেন্সর হল কয়েকটি বহুল ব্যবহৃত সেন্সর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পদার্থের চাপ, উষ্ণতা, আর্দ্রতা, দূরত্ব - এই জাতীয় ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মগুলি ট্রান্সডিউসারের সাহায্যে ভোল্টেজে রূপান্তরিত করা হয়। আরডুইনো ও সঠিক সেন্সরের মেলবন্ধনে বিবিধ প্রায়োগিক ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তৈরি করা সম্ভব। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য ইন্টারনেট অফ থিংসের (আই.ও.টি) হাত ধরেই প্রতিনিয়ত এই সেন্সরগুলির উন্নতি ঘটছে। যার ফলে একদিকে যেমন এদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে খরচও ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
ইলেকট্রনিক ব্লাড প্রেসার মাপক, পালস অক্সিমিটার, ইলেকট্রনিক ব্লাড সুগার মনিটর, ইলেকট্রনিক থার্মোমিটার, ইনফ্রারেড থার্মোমিটার এগুলি সবই সেন্সর কারিগরিতে তৈরি বায়ো-মেডিকেল গ্যাজেট। যা এখন আমরা সবাই দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এই ধরণের ইন্সট্রুমেন্টগুলিতে বায়ো-সেন্সর ব্যবহৃত হয়। এই সেন্সরগুলি শরীরের অ্যান্টিবডি, এনজাইম, রক্তকোষ ইত্যাদি জৈব-অণুর ধর্মকে ট্রান্সডিউসার ও সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনিক তন্ত্রের সাহায্যে সরাসরি ইলেকট্রনিক সিগন্যাল বা ভোল্টেজে পরিবর্তিত করে দেয়। অর্থাৎ আই.ও.টি এবং সেন্সর টেকনোলজির সৌজন্যে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, ভূতত্ত্ব এই ধরণের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়গুলিকে একই ছাতার তলায় এনে ফেলছে আধুনিকতম ইলেকট্রনিক্স। ঠিক এই কারণেই হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও যে কোনও ধরণের গবেষণামূলক বা কমার্শিয়াল ল্যাবরেটরিতে এখন অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ছড়াছড়ি। এই যন্ত্রগুলিকে সঠিকভাবে চালাতে এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুদক্ষ সঞ্চালকের প্রয়োজন সব জায়গাতেই। তাই এই ক্ষেত্রগুলিতেও ইলেকট্রনিক্স বিশেষজ্ঞদের জন্য চাকরি বা স্বনিযুক্তি প্রকল্পের জায়গা খোলা থাকছে ༺একথা বলাই বাহুল্য। আই.ও.টি. নিয়ে কাজ করা গবেষকরাও নিজেদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নিত্যনতুন সেন্সর তৈরি করতে পারেন এবং সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় ভৌতরাশিকে ভোল্টেজে পরিবর্তিত করে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন।