ঠিক যেন ভূমিকম্প! ঘণ্টায় ১৩০ কিমি বেগে শহরজুড়ে তাণ্ডব চালানো আমফানের ধাক্কায় থর থর করে কাঁপতে থাকা কলকাতার বহুতলবাসীদের এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে বুধবার রাতে।২০০৯ সালের আয়লা আর ২০১৯ সালে বুলবুলের স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে, তবে তুলনায় তাদের ধারেকাছে আসেনি আমফান, এমনই মনে করছেন পূর্ব কলকাতার বাসিন্দা বছর সত্তরের বিভূতিভূষণ দে। তাঁর কথায়, ‘বুধবার রাতে শহরময় যেন শিস দিতে দিতে বুলডোজার চালিয়ে সবকিছু তছনছ করে বেড়াল ঘূর্ণিঝড়। এর সঙ্গে আয়লা বা বুলবুলের তুলনাই চলে না।’কলকাতার বহুতলবাসী অনেকেরই আবার মনে হয়েছে, সাইক্লোনের ধাক্কায় গোটা বাড়ি দুলতে শুরু করেছিল। পূর্ব কলকাতারই এক আবাসনে ১০ তলার বাসিন্দা অর্পিতা পাল বলেন, ‘আমাদের মনে হল যেন গোটা বাড়িই দুলতে শুরু করেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম এর মাঝে ভূমিকম্পও বুঝি শুরু হল। পরে যখন বুঝলাম ঝড়ে বাড়ি কাঁপছে, তখন প্রচণ্ড আতঙ্ক হতে থাকল।’ এমনই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শরিক হয়েছেন টলিউড অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরার। টুইটারে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘ভূমিকম্প না সাইক্লোন?’ বুধবার কলকাতা শহরের এমন কোনও এলাকা নেই যা আমফানের রুদ্ররোষ থেকে রেহাই পেয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে পাড়ায় পাড়ায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে ভেঙে পড়া গাছের ডাল, কোথাও বা শিকড় সমেত উপড়েছে মহীরূহ। রক্ষা পায়নি ল্যাম্পপোস্ট আর ট্র্যাফিক সিগনালের খুঁটি। দুমড়ে মুচড়ে রাস্তাময় গড়াগড়ি খেতে দেখা গিয়েছে তাদের পাশেই পুলিশের ব্যারিকেডের লোহার রেলিং। একই সঙ্গে টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছে বাড়ির জানলার কাচ আর দোকানের গ্লো-সাইনবোর্ড।ঝড়ের সঙ্গে নাগাড়ে বৃষ্টিতে বহু এলাকায় রাস্তা জলমগ্ন হয়েছে, যা এ দিন বেলা পর্যন্ত সরেনি। ‘প্রায় প্রতি মিনিটে ডজন ডজন ফোন আসছে আমাদের কাছে,’ জানিয়েছেন কলকাতা পুরসভা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা এক আধিকারিক। গাছ ও ল্যাম্পপোস্ট পড়ে বহু রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক এলাকায় এখনও ফেরেনি বিদ্যুৎ বা ফোন পরিষেবা। গোটা কলকাতা যেন এক অসীম শক্তিধর দানবের আক্রোশের শিকার হয়েছে রাতারাতি। ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শহরের বস্তিবাসী। প্রবল হাওয়ার ঝাপটায় উড়ে গিয়েছে বহু বাড়ির টিন বা প্লাস্টিকের ছাউনি, লাগাতার বৃষ্টিতে ধসে পড়েছে পলকা দেওয়াল। রাতের অন্ধকার হাতড়ে অনেকে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন এলাকার স্কুল বা সরকারি দফতরবাড়িতে। এঁদেরই একজন ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস সংলগ্ন আনন্দপুরের বস্তিবাসী শীতলা। প্রশাসনের তরফে আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া সত্ত্বেও বুধবার সকালে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়শিবিরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তাঁর পরিবার। ভেবেছিলেন, আয়লা বা বুলবুলের চেয়ে হয়তো সামান্য বেশি হবে ঝড়ের দাপট। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে আমফানের তেজ। অঝোর বৃষ্টি আর দমকা বাতাসের ধাক্কা সামলে কোনও রকমে স্বামী ও বাচ্চাদের নিয়ে কাছের এক দোতলাবাড়ির নীচে রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুজে পেয়েছেন শীতলা। এই দুর্যোগে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন ভেবেই আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে এই পরিবার।