ইদানিং কালে বাংলা সাহিত্যজগতে এর থেকে বেশি দুঃসময়ের কথা মনে করতে পারছেন না সাহিত্যপ্রেমীর দল। গত সপ্তাহেই করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কিংবদন্তি কবি শঙ্খ ঘোষ। বর্তমানে করোনা আক্রান্ত হয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন বর্ষীয়ান সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। এবার করোনা কেড়ে নিল বাংলা সাহিত্যের আরও এক মহীরুহ সাহিত্যিক অনীশ দেব-কে। বুধবার সকালে শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন এই জনপ্রিয় সাহিত্যিক। বয়স হয়েছিল ৭০। গত কয়েকদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অনীশ দেব। এরপর সেখানে তাঁর করোনা পরীক্ষা করলে জানা যায় তিনি পজ𒀰িটিভ। গত মঙ্গলবার রাতেই ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয় এই বর্ষীয়ান লেখককে। একটু দেরি করে হলেও জোগাড় করা হয়েছিল প্লাজমা🃏র। তবে শেষরক্ষা হয়নি। তাঁর মৃত্যুতে পাঠকমহলে পাশাপাশি গভীর শোক নেমে এসেছে বাংলা সাহিত্যমহলে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,সমরেশ মজুমদার,প্রচেত গুপ্ত এর মতো বিখ্যাত সাহিত্যিক থেকে শুরু করে এ প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী,হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তরা তাঁদের মনখারাপ জানালেন। টুকরো টাকরা কথায় উঠে এলো ব্যক্তি অনীশ দেবের নানান অজানা কথা।
এ বিষয়ে এইমুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানালেন এরকম হঠা꧟ৎ চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। ভীষণ ভালো একজন মানুষ হওয়ার পাশাপাশি দুর্দান্ত একজন আয়োজক ছিলেন অনীশ। নতুন ও তরুণ লেখকদের যে ভীষণভাবে উৎসাহিত করতেন ' ভয়পাতাল' গ্রন্থের লেখা সেকথাও সোজাসুজি জানালেন 'দূরবীন' এর স্রষ্টা। এখানেই না থেমে শীর্ষেন্দুবাবু আরও যোগ করেন,'এত নম্র𝓰,চমৎকার ভদ্রলোক,কম কথার একটি ছেলে ছিল আমাদের অনীশ।পাবলিকেশন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ। সুচারু রসবোধের সঙ্গে মিশেছিল কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের ওপর তাঁর অগাধ জ্ঞান।' এরপরেই একটি মজার তথ্য দিলেন এই জনপ্রিয় সাহিত্যিক। জানালেন অনেকসময় তিনি ও অনীশ মিলে কোনও বই সম্পাদনা করলেও প্রচ্ছদে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নামটা থাকতো,ব্যাস ওটুকুই। বাকি সমস্তটুকু কাজ একহাতে সামলাতেন অনীশ দেব। একটু থেমে ধীর স্বরে স্বগতোক্তি করার মতো তিনি বলে ওঠেন,' কেন যে এতো তাড়াতাড়ি ও চলে গেল,বুঝতে পারছি না কিছুই।'
আরেক কিংবদন্তি সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার ফোনের ওপর থেকে জানালেন, অনীশ দেবের প্রয়াণের খবর তিনি শুনেছেন আগেই। গত চারদিন ধরেই প্রয়াত সাহিত্যিকের শরীরস্বস্থ্যের ব্যাপার♊ে নিয়ম করে খোঁজ নিচ্ছিলেন ' কালবেলা'-র লেখক। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে যে অনীশ দেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় সেকথাও ধীর স্বরে জানালেন সমরেশবাবু। এটুকু বলেই কাতর স্বরে তিনি অনুরোধ করেন,' অনীশকে হারিয়েছি। বিশ্বাস করুন,মনমেজাজ একটুও ভালো নেই। অনীশ শুধু প্রিয়জন-ই ছিল না,ছিল আমার পরিবারের মতোই। ব্যক্তিগতভাবে আমার অপূরণীয় ক্ষতি। আমি এর থেকে বেশি কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই এইমুহূর্তে।'
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য। প্রথমেই তিনি জানিয়ে দিলেন তাঁর 'অনীশ-দা' নেই এবং সে ব্যাপারে তাঁকে বলতে হবে এটা ভাবামাত্রই তাঁর প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। প্রচেতবাবুর কথায়,' বিশ্বাস করো,আমার একদম ভালো লাগছে না।আমি জানি না কী বলবো।কী যে ভীষণ ক্ষতি হলো আমাদের।' আফসোস তখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়ছে তাঁর গলা থেকে। এ🔯রপর ওঁনার পরিবারের ব্যাপরে খোঁজ নেওয়ার পর কথায় কথ🔯ায় উঠে এল প্রচেতবাবু ও তাঁর 'অনীশ-দা'-র নানান ব্যক্তিগত মুহূর্তের কথা। বললেন,' একবার বইমেলায় একটি নামজাদা প্রকাশনী স্টলে আমি আর অনীশদা বসে রয়েছি পাশাপাশি। পাঠকরা ছেঁকে ধরেছে তাঁদের প্রিয় কল্পবিজ্ঞানের লেখককে। অক্লান্তভাবে পাঠকদের বইয়ে সইয়ের আব্দার মিটিয়ে চলেছেন তিনি। সই করতে করতেই বেশ জোর গলায় একাধিক পাঠককে বলে উঠলেন,শুধু আমার বই পড়লেই হবে, প্রচেত গুপ্তর বই পড়ো। খুব ভালো লেখেন উনি। বলে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে তাঁর পাঠকদের। আমি তো অবাক! এরকম মানুষ ছিলেন অনীশদা।' আরও জানালেন,বিশ্বসাহিত্যের প্রায় অনেকাংশেই তাঁর নখদর্পণে ছিল। তার ওপর অসম্ভব যত্ন নিয়ে ছোট ও কিশো রদের জন্য লিখতেন। সঙ্গে ছিল অসম্ভব রসবোধ। 'অনীশ-দা' মুখ খুললেই যে দারুণ কিছু জানার পাশাপাশি তাঁর দুর্দান্ত রসের কথার স্বাদ পাওয়া যাবে এ বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল প্রচেতবাবুর। বক্তব্য শেষে তিনি জানান, ' এই মৃত্যু যেমন তাঁকে নাড়া দিয়ে গেল তেমন আরও একবার ভাবিয়ে তুলেছে সাহিত্যমহল একজোট হয়ে এই কঠিন সময়ে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে কি না।'
অন্যদিকে এই প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী বললেন,' করোনা যে আর কতজনকে কেড়ে নেবেন। গতকাল রাত থেকেই শুনছিলাম অনীশবাবুর শারীরিক অবস্♔থার অবনতির কথা। এরপর তো আজ সকালে এল এই খবর। জানি মৃত্যুর তো কোনও সান্ত্বনা হয়না। এ আসবেই,তবু ... মৃত্যু খুবই সত্যি আমরা স🦩বাই জানি কিন্তু আকস্মিকভাবে এরকম চলে যাওয়ার ব্যাপারটা মেনে নেওয়াটা ভীষণ কষ্টের।' 'জোনাকিদের বাড়ি' রচয়িতার কথায়, ' ছোটবেলা থেকে ওঁনার লেখা পড়ে আসছি। ওঁনার কল্পবিজ্ঞান,ভূতের বইয়ের কথা আমরা সবাই জানি। আমাদের বড় করার পিছনে অভিভাবকদের পিছনে লেখকরাও তো আছেন তাই তাঁরা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যান, তখন মনে হয় আমাদের কাছের এক অভিভাবক চলে গেলেন।'
এ সময়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত এর সঙ্গে অনীশবাবুর সম্পর্ক ভালো বললে কিছুই বলা হয়না। অনুজ লেখককে প্রায় আগলেই রাখতেন তিনি। হিমাদ্রিবাবু নিজেও স্বীকার করে নিলেন সেকথা,' আমার ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার পিছনে যাঁর অবদান প্রথম সেই মানুষটির নাম অনীশ দেব। যে পরিমাণ উৎসাহ ও ভরসা ওঁনার থেকে পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। উনিই বুদ্ধি দিয়েছিলেন যে আমি যেহেতু ইতিহাস নিয়ে কলেজে পড়াশোনা করেছি তাই ঐতিহাসিক কোনও অ্যাডভেঞ্চার যদি লেখা যায়. ভরসা পেয়েছিলাম এভাবেই। ' আরও জানালেন লেখার মারপ্যাঁচও স্বতঃপ্রণোদিত তাঁকে শিখিয়েছিলেন 'অনীশ-দা' . অনীশ দেবের ব্যাপারে বলতে গিয়ে হিমাদ্রিবাবু দৃপ্ত গলায় বললেন,'কল্পবিজ্ঞানকে যাঁরা জনপ্রিয় করেছিলেন সেই সত্যজিৎবাবু থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে অদৃশ বর্ধন সেই সমস্ত মানুষদের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন অনীশবাবু। এই যে কল্পবিজ্ঞান,রহস্যর জঁরকে আধুনিক মোড়কে ফেলে পাঠকদের সামনে পেশ করার ক্ষেত্রে যাঁরা ভগীরথের ভূম♈িকার পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন অনীশবাবু।' এখানেই না থেমে তিনি আরও বলেন এ প্রজন্মের বহু তরুণ লেখককে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পিছনে ছিলেন তাঁর 'অনীশ-দা'. তাঁর মধ্যে বক্তা নিজেও রয়েছেন। বইমেলায় নিজের পাঠকদের অনুজ পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত করানো থেকে শুরু করে তাঁদের হয়ে সোচ্চারে গলা ফাটাতেন। এরকমই এক ঘটনা উঠে এল হিমাদ্রি বাবুর মুখে,' একবার বইমেলায় বসে রয়েছি আমি আর অনীশবাবু। আমি তখন লেখা হিসেবে এক্কেবারে নতুন। সবে মাত্র দু-তিনটে বই প্রকাশ হয়েছে। ওদিকে অনীশ-দা তখন যাঁকে বলে 'ষ্টার'. তো সেই স্টলে ছেঁকে ধরা সইশিকারীদের আব্দার মেটাতে মেটাতে প্রায় প্রত্যেককেই বলতে শুরু করলেন তোমরা হিমাদ্রিকিশোরের লেখা বই পড়েছ ? একবার পড়েই দ্যাখোনা। খুব ভালো লাগবে।ভালো লেখেন তিনি। এইসব বলতে বলতে পাঠকদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তো তখন লজ্জায়,আনন্দে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। বলতে চাইছি এরকম মানুষ ছিলেন অনীশ দেব। বিরাট হৃদয় ছিল তাঁর।' লেখকের কথায় ' তেইশ ঘন্টা ষাট মিনিট'-এর লেখকের এই গুণ আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে। এইভাবে অনুজ লেখকে উৎসাহ দেওয়ার পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এরপরেই ধীরে ধীরে হিমাদ্রিকিশোরের কাছে অনীশবাবু হয়ে ওঠেন 'অনীশ-দা'।