বর্ডার তো তৈরি হতে দেখলুম!
‘জোয়ার ভাঁটাই তো ধর্ম! জোয়ার এলি মাছের সাথি জীবন আসে!’ কথায় কথায় এমনটাই বলেছিলেন জেলেপাড়ার সন্তোষ মণ্ডল। ইছামতীর তীর বরাবর সৈয়দপুর বিএসএফ ক্যাম্প। তার কিছুটা আগেই জেলেপাড়ার ক্লাবঘর। পাশে কেটে রাখা এক গাছের গুঁড়িতে বসে কথা হচ্ছিল আশি পেরনো সন্তোষ মণ্ডলের সঙ্গে। একপাশে বানিয়ে রাখা নৌকার ছই আর দুই গাছের সঙ্গে টাঙানো মাছ ধরার বিশাল জাল। দশ ফুট দূরে বয়ে চলেছে ইছামতꦇীর ঘোলা জল। নদীর ওপারে বাংলারই ঘন গা꧙ছগাছালি। হঠাৎ দেখলে যা কখনও অন্য দেশ বলে মনে হবে না।
‘মাছ ধরা ছাড়ছি পনেরো বছর আগে। আমার ৪৭-এর আগে জন্ম।’ কৌতꦬুহলটা বাড়ল — নদীর মধ্যে বর্ডার ছিল তখন? ‘বর্ডার তো তৈরি হতেই দেখলুম! কাঁটাতারের বেড়া চোখের সামনেই দিছে। সুভাষ থাকলি অবশ্য এসব হত না। জোড়াই থাকত দেশটা!’ প্রশ্ন করলাম, একথা কেন বলছেন? একরকম চাপা ক্ষোভ উগড়েই বলে উঠলেন, ‘বিনি স্বার্থে দেশের জন্য লড়ছে সুভাষ, ক্ষুদিরাম, অভিরামরা! ওরꦫা থাকলি এসব হত নাকি! মনে নেই, ক্ষুদিরামকে ফাঁসিকাঠে তোলার সময় কী গান গেয়েছেল! — একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/ হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী। অত পড়াশোনা করি এসেও দেশের জন্য লড়ছিল সুভাষ। বইতে পড়নি আইসিএস পাশ করি এল? তার পরও সব ছাড়ি দিল দেশের জন্য!’ কথার সুর এমন যেন, নিজের বাড়ির ছেলের কথাই বলছেন বৃদ্ধ সন্তোষ। সে চলে যাওয়ায় ‘সংসার’ দুভাগ হওয়ার কাহিনি শোনাচ্ছেন!
‘হিন্দু, মুসলমান, সবকো মারদো!’
১৯৭১, বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। লাখ লাখ মানুষ হত্যার নেপথ্য নায়ক ইয়াহিয়া খান। কথা বলতে বলতেই তার উদ্দেশ্যে তুমুল গাল পাড়লেন বৃদ্ধ। ‘পিপড়ের ম🐼তো মানুষ মারছে খানসেনারা।’ অর্বাচীনকে একরকম শেখানোর ভঙ্গিতে সন্তোষ বললেন, ‘ইয়াহিয়া খান ছেল পাকিস্তানের পাঠানো লোক। সে-ই তো বলল, হিন্দু, মুসলমান, সবকো মারদো! মানুষ জান বাঁচাতি ভিটে ছাড়ি পালাল।’ ইছামতীতে মাছ ধরতেন বলে ওপারের সঙ্গে তাঁর ভালো আলাপ ছিল একসময়। সে সময় অনেককে পারাপারও করেছেন সন্তোষ।♏ তাদের মুখে শুনেছেন স্বজন হারানোর কাহিনি। ‘এক স্কুলঘরের নিচে ডিনামাইট পুঁতে গেছে খানসেনারা, স্কুলের কেউ জানত না। কচি কচি বাচ্চারা ক্লাস করছে। হঠাৎ ভরদুপুরে বিষ্ফোরণ। ধসে পড়ল দোতলা স্কুলটা। বাচ্চাদের ছোট ছোট শরীর। কংক্রিট আর শরীরগুলান পুরো মিশে গেল!’ সন্তান হারানো বাবার চোখের জল ইছামতীতে পড়ল। পড়ার পর মিলিয়েও গেল, নিরুদ্দেশ!
‘কে হিন্দু, কে মুসলমান দেখিনি’
ইছামতীর বুক জুড়ে এমনই চোখের জল আর রক্তের নানা কাহিনি। সাতচল্লিশ আর একাত্তরে যার সবচেয়ে বেশি ক্ষরণ। সাতচল্লিশে নেহাত ছোট্ট হলেও একাত্তরের ঘটনা সন্তোষের স্মৃতিতে বেশ টাটকা। তখন কয়েক মাস মাছ ধরা বন্ধ । তবু রোজ নৌকা নিয়ে ইছামতীতে হাজির দেন। হাজার হাজার মানুষ ওই পারে । খানসেনাদের হাতে পড়লেই মৃত্যু অনিবার্য। তাদের এপারে নিরাপদে নিয়ে আসাই তাঁর মতো জেলেদের কাজ। সন্তোষের কথায়, ‘৭১-এ মাছ না ধরে এটাই করছি আমরা। মুক্তি ফৌজ আর ইন্দিরা গান্ধি না থাকলি খান𒉰সেনাকে কে জব্দ করত!’
কৃষ্ণনাম করেন বৈষ্ণব সন্তোষ। কিন্তু তাঁর কথায় নদী পারাপারের সময় ‘কখনও কে হিন্দ𒁃ু, কে মুসলমান দেখিনি। জানের ভয় থাকলেও পার করছি সবাইকে।’ নদী পারাপার করিয়েই তখন রুজি রোজগার চলত। রোজগারের ঠিক ছিল না। ‘কেউ নয়া পয়সা দিত, কেউ এক টাকা, কেউ আবার বলত, আমার কাছে কিছু নাই, এই থালা, বাসন নে নাও। মনে খুব ধাক্কা লাগছেল জানো! ওসব কখনও নিইনি। বলিছি, এগুলি যা আছে নিয়ে গিয়ে নতুন সংসার করো গে।’ সন্তোষের গলা ভারি। ‘তখন সবার তাড়া। নৌকায় উঠতে মারামারি লাগত। আমরা বলতাম দাঁড়াও, আসব আবার। বেশি লোক নিলে তো উল্টে যাবে নৌকা।’ শুধু মাছ নয়, ইছামতীর কাঁটাতারের জালে মানুষও কত আটকেছে!&nb🃏sp;
ছেলের নাম সুভাষ
স্বাধীনতা দিবস এলেই চোখের সামনে দেখা উত্তাল সময়টার কথা বেশি করে মনে পড়ে সন্তোষের। অনেককেই বলতে শোনা যায়, বয়স হলে মানুষ বারবার এক কথা বলেন। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে একটি বিশেষ কথাই ফিরে ফিরে আসছিল সন্তোষের মুখে। ‘স্বাধীনতা কি এমনি জিনিস! বিনি স্বার্থে দেশের জন্য যারা প্রাণ দেছিল তারা না থাকলি এত সুখ পাইতে!’ স্বাধীনতা শব্দের মানে তাঁর কাছে সুভাষ, ক্ষুদিরাম,𝓀 অভিরামের মতো বিপ্লবীরা। বিপ্লবীর অর্থও যত্ন করে বারবার বোঝান নদীর বুকে লড়াই করা বৃদ্ধ। ‘বিনি স্বার্থে দেশের জন্য’, ‘বিনি স্বার্থে দেশের জন্য’...🌜. । আদর করে ছেলের নাম রেখেছেন সুভাষ! ইছামতীর তীরে বসে তার ঘরে ফেরার প্রহরও গোনেন রোজ।