২০ টাকা মাইনেতে কাজ ধরেছি
‘তেইশ বছর এ লাইনে কাজ করছি ভাই। সবরকম কাজই কর꧃ি পেটের দায়ে।’ রেলের ঠিকাদারের কাগজে কলমে সাফাইকর্মী কালীদা। যখন এ কথা বলছেন, ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে মধ্যমগ্রাম স্টেশনে। ডিউটি তাঁর শেষ হয়েছে বেলা ২ টোয়। স্টেশনমাস্টার ডেকে পাঠানোর পর যখন দেখা হল, চোখ লাল, মুখ থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। ‘শ্রীমান হরি কালীপদ দাস,♛ ইংরেজিতে কেপিডিএস।’ নাম জিজ্ঞেস করলে এভাবেই উত্তর দেন কালীদা। ২৩ বছর ধরে তো এই কাজ করছেন, অভিজ্ঞতা কেমন? কথা শেষ না হতেই বছর সাতচল্লিশের মানুষটা বলে ওঠেন ‘অভিজ্ঞতা! ২০ টাকা মাইনে থেকে কাজ ধরেছি। হেসে খেলে সংসার চলে যেত।—’
-‘কোন সাল তখন?’
-‘১৯৯৮। আমি যখনকার লোক, তখনকার সব রিটায়ার🎉 হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু এই কালী আর বিধান আছে। দত্তপুকুরেও কাজ করেছি। এই যে দেখছ, এ ট্র্যাক রোজ পরিষ্কার করি ২৩ বছর ধরে। বাথরুম সাফ করি। স্টেশন ঝাড় দিই। কালীপদর সবেতেই ডাক পড়ে!’ শুধু সাফাইয়ের কাজ নয় কেউ ট্রেন থেকে পড়ে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে? কালীদাকে ডাকো। কেউ লাইনে কাটা পড়ল, শশ্মান যেতে হবে? কাঁধ লাগাতে হয় কালীদাকেই🐓। দুদিন আগের একটা ঘটনার কথা জানালেন তিনি। ‘রাতের দিকে কেউ একটা লোককে ফেলে দিয়ে গেছে এই স্টেশনে। মাথার চামড়া উঠে গেছে। মাংসে পোকা গিজগিজ করছে। ঘেন্নায় কেউ কাছে যাচ্ছে না। এই আমিই কিন্তু তাকে হাসপাতাল দিয়ে এলাম।’ এসবের বদলে কখনও কারও থেকে টাকা চাননি। তবে নিজে থেকে কেউ দিলে একটু গলা ভিজিয়ে নিয়েছেন রাতের দিকে। নিজেই স্বীকার করেন, দোষের মধ্যে একটু মদ খাওয়া এই যা!
পেটের দায়ে ম্যানহোলে
পেটের দায়ে ম্যানহোলেও নেমেছেন অনেকবার। ১২-১৩ বছর আগের সেই অভিজ্ঞতার কথাও শোনালেন ‘শ্রীমান হরি কালীপদ দাস, ইংরেজিতে কেপিডিএস।’ ম্যানহোলের বিষাক্ত গ্যাস মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কিছু দিন আগেই খবরে এসেছিল কলকাতার বুকে এমন মৃত্যুর ঘটনা। মানুষকে দিয়ে ময়লা সাফ অর্থাৎ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় সরকার আইন করেছিল ১৯৯৩ সালে। ২০১৩ সালে সেই আইনে বড়সড় সংশোধনও করা হয়। কিন্তু কে না জানে আঁটুনিটাই বজ্র করা হয়েছিল, গেরোটা যায় ফস্কেই। তাই অবাক না হয়ে অন্য প্রশ্নে আসা গেল— প্রাণের ভয় করত না?অট্টহাসি হেসে বললেন, ‘ভয়! পেটের দায় থাকলে সব ভয় জয়। মরব তো একবার, বারবার না। ডিউটি শেষে লোকের বাড়ি টয়লেটও সাফ করে দিই। ১০০-২০০ টাকা বেশি ইনকাম হয়, পেট চালাতে ༺হবে তো!’
স্টেশনমাস্টারের ঘরের সামনেই দোতলায় পতাকা উত♉্তোলনের বেদী। ১৫ অগস্টের জন্য বেদীর সামনেটা সাফ করা হয়েছে। কথা হচ্ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই। কাল কী কী হবে? ‘পতাকা তোলা হবে, বড়বাবু জিলিপি দিলে খাব।’ জিলিপি শব্দটা বলতে বলতেই তাঁর মুখে কী সুন্দর প্রাণ জুড়োনো হাসি! ‘তবে কাজে কামাই নেই’, সেটাও বড় চোখে বললেন কালীদা। ‘জিলিপি খেয়েই ꧋আবার সাফাই করতে লাইনে নেমে পড়ব।’
কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন
আগের তুলনায় সময় এখন অন্যরকম। কন্ট্রাক্টে কাজ শুরুর পর থেকেই অবস্থা খারাপ! আগে স্টেশনের বড়বাবুরা বছর বছর মাইনে বাড়াত। ২০ টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা মাইনেও হয়েছে কিছু দিন আগে। কিন্তু এখন অন্য লোকে ঠিকে নেওয়ায় মাইনে কমে আট হাজার! পিএফ, ইএসআই কেটেকুটে হাতে আসে ছ꧟য় হাজার! কালীপদ বলে ওঠে, ‘এতে সংসার চলে! গোবরডাঙায় বাড়ি। যাই না, এখাꦦনেই থাকি!’
কালীদার চোখে জল। সন্তান ও স্ত্রীকে অনেকদিন না দেখতে পাওয়ার জল। কথায় কথায় জানা গেল স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে সংসার। ছেলের বয়স ২৭ বছর। থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ানোর পর লকডাউন হয়ে যায়। পেটের দায়ে সে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। সিভিক পুলিশ। কিন্তু কাজ করলেও দেখা মেলেনি মাইনের। ‘দেড় বছরে এক লাখ ৭২ হাজার টাকা এখনও পায়নি ছেলে’ নির্ভুল হি🌊সেব দেন বাবা। সে চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি খুঁজছে এখন। ওদিকে মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে। টাকা লাগবে, টাকা কই? ‘পাঁচ তারিখ মাইনে দেওয়ার কথা, মেয়ের ডেলিভারির কথ♚া বলতে এই আজ ১৪ তারিখ মাইনে দিল! ছয় হাজার টাকা!’
‘সৎভাবে কাজ করি। কখনও অসৎ কাজ করিনি। কিন্তু🐼 সংসার চালানোর মতো রোজগার করি না, কোন মুখে যাব বাড়িতে?’ সম্পর্ক নিয়ে তাঁর যা-ই বিশ্বাস থাক, শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে এই প্রশ্নই করেন কালীদা। কাকে? নিজেকে? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের ছেলের বয়সি ছেলেটাকে? না স্বাধীন ভারতবর্ষকে? বোঝা যায় না ঠিক?… নাকি বোঝা যায় সবটাই?