অনিন্দিতা ঘোষাল
৫ অগস্ট, ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বার্থেই এক ম🌟নে রাখার মতো দিন। কিন্তু এই দিনকে কে, কীভাবে মনে রাখবেন, নেতিবাচক ও ইতিবাচক পরিপ্রেক্ষিত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্তরণের ঘটনাকে দেখা জনসাধারণের মধ্যে ইতিমধ্যেই জোর শোরগোল শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়া তথা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও, মাত্র এক মাসের কম সময়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরে যে এক সার্বিক পট-পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, তাতে রাজনীতি-সমাজতত্ত্বের তথাকথিত পাঠ, এমনকী তার ইতিহাস-ভূগোল অবধি গুলিয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। বহির্বিশ্বের কথা আপাতত দেওয়া যাক, কিন্তু ভারত-মায়ানমার, পাকিস্তান বা চিনের মতো প্রতিবেশী রাজ্যে তো বটেই, স্বয়ং বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষও, কেউই মনে হয় এতটা সার্বিক বিপ্লব বা আমূল পটপরিবর্তন কথা কল্পনা করেননি। তাঁরা আশা করেছিলেন হয়তো, এই আন্দলন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতি, বিশেষ করে বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি, দলতন্ত্র খানিকটা হলেও কমাবে। তাই, ঘটনার পর্যায়ক্রম শুরু থেকেই বরং শুরু করা যাক।
২০১৮ সালের পর, বাংলাদেশে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিতে ‘কোটা ব্যবস্থা’ নিয়ে আদালতের রায় বেরিয়েছিল, এই শেষ 🐲ঈদের ছুটির আগে। আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, সেই প্রদত্ত রায়কে চ্যালেঞ্জ করার জন্য, রোজা মাস কাটার অপেক্ষায় ছাত্ররা অপেক্ষা করেছিল এক মাসের বেশি সময়। কিন্তু আচমকা সেই ছাত্ররাই ‘বৈষম্য-বিরোধী ছাত্রদল’ এবং তার সমন্বয়কদের তৈরি করে। তারা একেবারে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করলে, সমাজের অন্যান্য অংশের, বিশেষ করে সাধারণ পরিবারগুলোর সমর্থন এবং অংশগ্রহণ পায়। এরা দীর্ঘ সময় ধরে হাসিনা সরকারের দুর্নীতির নেটওয়ার্কের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ, ভীত, সন্ত্রস্ত বা বিরক্ত ছিল। তাই বামপন্থীরা তো বটেই, আওয়ামি লিগ সরকারের মুল প্রতিদ্বন্দ্বী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামাতে ইসলামী দলের থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন পেয়ে, ‘বৈষম্য-বিরোধী ছাত্রদল’ নেতৃত্বে থেকে, বাংলাদেশের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনে বিএনপি আর জামাতের ক্যাডাররা ছাড়াও এনজিওগুলোর নাকি সক্রিয় ভূমিকা ছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে আসে যে, দক্ষিণ এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’ বলে অভিহিত শেখ হাসিনাকে সামরিক বাহিনীর শর্ত মেনে ও সহায়তা নিয়ে, আপাত রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ভারতে পালিয়ে আসতে হয়।
এই ঘটনা অব্দি প্রায় সবার জানা। তারপরে যা যা হয়েছে বাংলাদেশে, ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে সহজেই তার একটা প্যাটার্ন খেয়াল করা যায়। বিশ্বায়ন তো বটেই, এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে, শেখ হাসিনা ভারতে পৌঁছে যাবা𒆙র আগেই, আওয়ামি লিগের অনুসারীদের মতে, ১৯৭১ সালের পরে যে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিরা বাংলাদেশে আছে, তারা গনভবনে লুঠপাট শুরু করে। একে একশ্রেণীর বাংলাদেশিরা মুজিবকে হত্যার আগে তাঁর একদলীয় শাসনের কথা ভুলে যাননি, তার সঙ্গে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো শেখ হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে তাঁর বাবার নাম ব্যবহার করেছেন বার বার। সেই রোষেই মুলতঃ শেখ মুজিবের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, মূর্তি, ম্যুরাল ভাঙার ছবিও আসতে শুরু করে। শুরু হয়, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শুরু হয় ডাকাতিও। এসব ঘটনা থেকে যে জিনিসꦺটা আরও স্পষ্ট হল তা হচ্ছে, হাসিনার সময় থেকে আওয়ামি লিগ বিরোধীদের কলঙ্কিত এবং বিচ্ছিন্ন করা তাঁর রাজনৈতিক পুঁজি হয়ে উঠেছিল, তার ঐতিহ্য মেনে ভিন্নমতের মানুষদের শত্রু বলে দেগে দেওয়া, আয়নাঘরে গুম করে তাঁদের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। তাই বাংলাদেশে এখন পরিবার-বিরোধী রাজনৈতিক শ্লোগানে খানিক অস্বস্তিতে বিএনপিও। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের আগের সেই ‘আমরা, ওরা’ সংস্কৃতির মতো। তাতে একদিকে শুরু হয়েছে, নতুন করে সব কিছু শুরুর খুশি, অন্যদিকে আবার পুরনোকে হেনস্থা করা। বাংলাদেশে সমাজের সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে, ‘কী হয়, কী হয়, কী জানি কী হয়’ অবস্থা, যাতে অধিকাংশ মানুষেরই আবার ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মতো সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান নিতে প্রায় বাধ্য হচ্ছেন।
একবিংশ শতকের এই বাংলাদেশ আসলে কেমন, সেটা অধিকাংশ মানুষের দেখার বা বোঝার সুযোগ হয়েছে এই শেষ কয়েক সপ্তাহে। কিন্তু ইতিহাসের আলোয় দেখলে, আসলে পূর্ববঙ্গ বলে এই ভৌগোলিক অঞ্চলের সংস্কৃতি কেমন ছিল? এবারে যে হিংসা, প্রতিশোধ-পরায়নতা, আবার অন্যদিকে জয়ের উল্লাসে, একদিকে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম, আবার অন্যদিকে রাহুল আনন্দের মতো শিল্পীর বাড়ি পুড়িয়ে দেখেছি, তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসে যে কোনও সার্বিক বিদﷺ্রোহ বা বিপ্লবের পর এরকম পরিস্থিতি হয়, লুঠতরাজ চলে, আবার সাহায্য-সম্প্রীতি-সহানুভূতির ছবিও দেখা যায়। এবারেও তার ব্যত্যয় হয়নি।
সমস্যা 💙শুরু ‘রাজাকার’ শব্দকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই শব্দের মর্মার্থ সবাই জানেন। তবু বর্তমানে এই শব্দকে ওই অঞ্চলে নিত্ত-নৈমিত্তিক জীবনে এত নেতিবাচক ভাবে বলা হয়, যেন এই শব্দের মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ মতো। আসলে, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে কোনও শব🌼্দের মানে যে কী দাঁড়ায়, তা হয়তো সে ভাবে ঠিক বোঝাও যায় না। তাই যত রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের কারণকে এখন ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, ২০২৪ সালে বাংলাদশের ইতিহাস যত বার, যত ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে লেখা হোক না কেন, এই শব্দ-বন্ধ বার বার ফিরে আসবে। ছাত্র আন্দোলনে ব্যবহৃত শ্লোগানগুলো থেকে তা স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গুজব। বাংলদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন নতুন কিছু নয়, তবে সম্প্রতি আমরা যা দেখেছি তা যে কোনও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্লভ বলা যায়।
এবারে আসা যাক, শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর ঘটে যাওয়া হিংসা প্রসঙ্গে। ইতিহাস বলে, পূর্ববঙ্গে সুফি-সন্তরা যে ইসলামের প্রবর্তন করেছিলেন, সেটা কখনও ‘পলিটিকাল ইসলাম’ ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে ‘ছোঁয়া না-ছোঁয়া’ নিয়ে এক ধরনের সনাতন সংস্কৃতি থাকলেও, পূর্ববঙ্গে আসলে এক ধরনের মিশ্র সংস্কৃতি ছিল। ঔপনিবেশিক যুগে, যখন প্রথম সাম্প্রদায়িকতার ধারণা শাসনের ধারা হিসেবে আসছে, তখনও কিন্তু ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশীদের মধ্যে সুসম্পর্কের কথা সে সময়ে লেখা অনেকের আত্মজীবনীতে আছে। স্বাধীনত🍌া পরবর্তী সময়েও যত রকম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ হয়েছে📖, তার কারণ বেশিরভাগ সময়ে ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নয়। বিশেষ করে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর থেকে, পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে উৎখাত করার মূল কারণ ছিল, তাদের চাষের জমি, বসতবাটি বা অন্যান্য সম্পত্তি দখলের সুবিধে। তাহলে, এবারে কী হল? আসলে শেষ ১৫ বছরে আওয়ামি লিগ এক ধরনের যুক্তি খাড়া করতে সমর্থ হয়েছিল যে, এই দল অসাম্প্রদায়িক। তাই, আওয়ামি লিগ বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে, হিন্দুরা সুরক্ষিত থাকবে। ধরে নেওয়া হত, হিন্দুদের ভোটও আওয়ামি লিগ পায়। তাই, নিউটনের তৃতীয় সূত্রকে সত্যি প্রমাণিত করে, এবারেও হিন্দুদের ওপর জুলুম, হিংসা, এমনকী মৃত্যুর ঘটনাও অনেক হয়েছে। সবচেয়ে মনখারাপের ঘটনা হল, তার সঙ্গে হিন্দুদের নামাঙ্কিত প্রায় সব তোরণ, স্মৃতিসৌধ মুছে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে, ডক্টর ইউনুস যার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী দিয়েছেন। তথাকথিত পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের মতে, এটা আওয়ামি লিগ ও হাসিনার অনুসারীদের খানিকটা অপপ্রচারও। কারণ তারা পুনরায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও হাসিনার প্রত্যাবর্তন চায়। কিন্তু আশার কথা হল, সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, সাধারণ মানুষ, এমনকী মাদ্রাসার ছাত্ররা একত্রিত হয়ে মন্দির পাহারা দিয়েছে, ডাকাতদের হাত থেকে হিন্দু সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন রকম প্রচেষ্টা করেছে— এমনই শোনা গিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও জমায়েত করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো আন্দোলনে সার্বিক ভাবে অংশগ্রহণ করা শহরে, শ্লোগান দিয়েছেন, ‘আমার মাটি, আমার মা, বাংলাদেশ ছাড়বো না’।
এবারে রাজনীতির কথায় আসা যাক। পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে নেতাদের উত্থান-পতন, বিরোধিতা, বৈরিতা অতীতে কম হয়নি। ক্ষমতা চলে যাবার পর বিশালদেহী ফজলুল হক সাহেবকে প্লেনে বসে অনেকে কাঁদতে দেখেছেন, নুরুল আমিন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কারচুপি না করে, তিনি পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন রাজনীতিতে হাতখড়ি দেওয়া এক ছাত্রসম প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে, এমনকী মৌলানা ভাসানীও ‘ন্যাপ’ বলে নতুন দল তৈরি করার পর, মুজিবের রাজনীতিকে প্রকাশ্যে সেভাবে অসম্মান করেননি। তাহলে, এই হিংসা-প্রতিশোধের রাজনীতির শিকড় কোথায়? এর ইতিহাস খুঁজতে হলেও ফ𝔉িরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যখন ‘মুজিব বাহিনী’ বলে এক দল তৈরির সঙ্গে সঙ্গে, নেতা-কেন্দ্রিক এক আনুগত্যের সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা দেখা গিয়েছে, যাতে প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন বাংলাদেশ গড়ার আরেক কারিগর, আপাত মুখচোরা, লাজুক স্বভাবের নেতা তাজউদ্দীন আহমেদও। এই পরিবারকেন্দ্রিক দলের আর এক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল, বিএনপিও। তাতে আখেরে ক্ষতি হয়েছে, আসলে দেশটার। এবারের ‘গণজোয়ার’-এর পরে ছাত্ররা নাকি দাবি রেখেছে, কোনও দলের কোওন নেতাই মোট দু’বারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। সেটা সত্যি হলে, হয়তো এই পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির সংস্কৃতির ধারা কখনও বিলুপ্ত হবে, উঠে আসবে নতুন যোগ্য, দীপ্ত মুখরা।
এবারের গনআন্দোলনে সঙ্গে যে ভূ-ত্বাত্বিক রাজনীতির একটা স্পষ্ট যোগ আছে, তাতে এত দিনে কারও কোনও সন্দেহ নেই। শাহবাগ আন্দোলনের সময়, মোবাইল-ল্যাপটপে আপাত মুখ গুঁজে থাকা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের একটা চিত্র পাওয়া গিয়েছিল। এবারের আন্দোলনে সেই রূপ তীব্র তো হয়েছেই, তার সঙ্গে জুড়েছে অনেক সন্দিগ্ধ প্রশ্ন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, যা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে মাইলফলক, তাতে শহিদ হয়েছিলেন মোট পাঁচ-জন। মুক্তিযুদ্ধের আগে, গোটা পাকিস্তানের সময়ে, ১৯৪৭-১৯৭০ এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন, হয়তো জনা পঁচিশেক। ১৯৭১ সালের গনহত্যাকে ধরলেও, এবারের প্রতিবাদ-আন্দোলনে যে মৃত্যু মিছিল দেখা গিয়েছে, তা অতীতের সব রকম সংজ্ঞাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। শেখ হাসিনা শাসনক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবার আগে, সেনাবাহিনী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছিল বলে, খবর প্রকাশিত হয়েছে অনেক গণ-মাধ্যমে। নাহলে এই মৃত্যুহার কোথায় থামত, কে জানে! সে জন্যই আওয়ামি লিগ সরকারের সময়ের সব রকম সমৃদ্ধির তথ্য চাপা পড়ে গিয়েছে স্বৈরাচার𒁃ের তত্ত্বে। আয়নাঘরে গুম করা, চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর রাষ্ট্রের নিপীড়ন, সার্বিক জুলুম, শাসনের নামে শোষণ, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি কেমন মুজিবের সময়ের ‘বাকশাল’ সময়ের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। হাসিনার সময়ে পরিকাঠামোর উন্নয়নের স্রোতের সঙ্গে আসলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল সর্বস্তরে দুর্নীতিও। নিন্দুকেরা আইএমএফ এবং ডব্লিউবি রিপোর্টকে উল্লেখ করে বলেন, হাসিনা বিদেশ থেকে বহু বিলিয়ন ডলার ধার নিয়েছিলেন বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য, কিন্তু তাঁর সহযোগী বন্ধুরা নাকি সেই উন্নয়নের আড়ালে থেকে সেই অর্থের বেশির ভাগটাই করায়ত্ত করেছেন।
তাই, এই নতুন সরকারের সামনে আসলে অনেক সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ। তাঁদের এখন সবচেয়ে বড় কাজ হবে, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা, আইনের শাসন কায়েম করা, মহিলাদের অধিকার নিশ্চিত করা, আইনকে ঢেলে সাজানো, দুর্নীতি অপসারণ, সমস্ত সংখ্যালঘুদের সাধারণ ‘বাংলাদেশী’র মর্যাদা দেওয়া। এই আন্দোলনের যে একটি ভারত-বিরোধী গতꦡিপথ রয়েছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। দুর্ভাগ্যবশত হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর সেই ক্ষোভ পড়েছে। কিন্তু এই সার্বিক পরিবর্তনে বিএনপি, জামাত, কিছু বামগোষ্ঠী এবং এনজিওকে দোষারোপ করে একটা কার্যকারণ সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা হলেও, এই আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিক মেলবন্ধন, ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার যে ইতিবাচক ছবি দেখিয়েছেন। এখন দেশ ও জাতির উচিত, সেই সামাজিক মূল্যবোধকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা, বিশেষতঃ কান্ডারি হিসেবে আপাত বাংলাদেশের সব দল যাকে ‘বিকল্প’ হিসেবে সমর্থন করেছে, বিদেশের শক্তিরাও তাকে সমর্থন করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্ততঃ সহযোগিতা করা। আবু সায়েদ বা মির মুগ্ধের রক্তস্নাত আজকের এই বাংলাদেশ তবেই আগামীকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারবে। শান্ত হবে সোনার দেশ, স্বস্তিতে থাকবে দেশবাসী।
(লেখক সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ডায়মণ্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়। যোগাযোগের মাধ্যম: [email protected]। মতামত ব্যক্তিগত)