বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টের পাওয়া যাচ্ছে৷ সুমেরু অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে সেই বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কেও আরেও স্পষ্ট চিত্র উঠে আসছে৷ আবহাওয়াবিদ মারিয়ন মাটুরেলি প্রায় ২০ বছর ধরে নিয়মিত নরওয়ের স্পিৎসবার্গেন দ্বীপে যান৷ মেরু অঞ্চলের জলবায়ুর উপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি৷ ইউরোপের উত্তরতম প্রান্তের জনবসতি ‘ন্যু আলেসুন্ড' অতীতে কয়লা খনির কারণে পরিচিত হলেও বর্তমানে জলবায়ু বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷ দশটি দেশ সেখানে রিসার্চ স্টেশন গড়ে তুলেছে৷ফরাসি-জার্মান যৌথ স্টেশনের ছাদে পরিমাপের একাধিক যন্ত্র বসানো রয়েছে৷ মাটুরেলি সেখানে আবহাওয়া বিজ্ঞানের জন্য প্রাসঙ্গিক নানা তথ্য সংগ্রহ করেন৷ মাটুরেলি বলেন, ‘এগুলি একেবারে মৌলিক তথ্য, যেমন তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসের চাপ এবং বাতাসের গতি৷ সেইসঙ্গে অবশ্যই মেঘ, মেঘের কণা, মেঘের মধ্যে তরল ও শক্ত বরফের কণা, এয়ারোসোল সংক্রান্ত তথ্যও রয়েছে৷ মোটকথা যা কিছু বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়৷ ট্রেস গ্যাসের উপরেও নজর রাখা হয়৷ আমরা একদিকে বায়ুমণ্ডলের অবস্থা নথিভুক্ত করি, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে সেগুলির কারণ খোঁজার চেষ্টা করি৷’বেশ গুরুতর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ সুমেরু বৃত্তের উত্তরের এই স্থানে এমনকি শীতকালেও ফিয়র্ড বা খাঁড়িগুলি আর বরফে জমে যাচ্ছে না৷ খুব উঁচু জায়গা ছাড়া তুষারপাতও হচ্ছে না৷ সমুদ্রের উপর ভাসমান বরফ গলে চলেছে এবং পারমাফ্রস্ট জমিও আরও পাতলা হয়ে যাচ্ছে৷জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা গড়ে প্রায় এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে৷ অথচ শুধু স্পিৎসবার্গেন দ্বীপে গত ২০ বছরে তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি বেড়ে গেছে! মাটুরেলির মতে, বাতাসের গতি পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ৷ নিজের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে শীতের মাসগুলিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে বাতাসের স্রোত আরও বেশি করে দক্ষিণ দিক থেকে আসছে৷ ক্রান্তিমণ্ডলীয় এলাকার সেই বাতাস উষ্ণ ও আর্দ্রতা নিয়ে আসছে৷ এখানকার বৃষ্টিপাত ও মেঘের উপর তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে৷ ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ুও বদলে যাচ্ছে৷’ ১০,০০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের এক প্রণালী সুমেরু অঞ্চলে দক্ষিণের বাতাস টানার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে মাটুরেলি অনুমান করছেন৷ বিষুবরেখার কাছে উষ্ণ বাতাস আকাশে উঠে উত্তর দিকে ধেয়ে গিয়ে মেরু অঞ্চলের শীতল বাতাসের সঙ্গে ধাক্কা খেলে সেই পোলার জেট স্ট্রিম সৃষ্টি হয়৷কিন্তু তাপমাত্রার মধ্যে ফারাক নাটকীয় মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় দুই বাতাসের মধ্যে দ্রুত মিশ্রণ এখন আর সম্ভব হচ্ছে না৷ পৃথিবীর আবর্তনের ফলে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সেই বাতাসের গতি বাড়ে৷ এখনও পর্যন্ত সেই উচ্চতার বাতাস ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫০০ কিলোমিটার বেগে স্থিতিশীল এক করিডোরের মাধ্যমে হালকা ঢেউয়ের মতো গতিপথে উত্তর গোলার্ধ পরিক্রমা করত৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই প্রণালীতে বিঘ্ন ঘটছে৷ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মারিয়ন মাটুরেলি বলেন, ‘সুমেরু অঞ্চল ও পৃথিবীর মধ্যভাগের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য আর তত বেশি না হওয়ায় বাতাসের অবস্থাও বদলে যাচ্ছে৷ তথাকথিত জেটস্ট্রিমের মতো দ্রুতগামী বাতাসের সমান্তরাল স্রোত দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ বাতাস আর আগের মতো শক্তিশালী না হওয়ায় সেই স্রোতের গতিপথ বেঁকে যাচ্ছে৷’এবার বেলুনে গ্যাস ভরার পালা৷ পরিবেশ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ফিকে রাডের এক বছর ধরে এই স্টেশনে গবেষণা চালাচ্ছেন৷ সংবেদনশীল পরিমাপ যন্ত্রভরা ওয়েদার বেলুনের প্রস্তুতিও তাঁর দৈনিক কাজের মধ্যে পড়ে৷