বাংলার বীরভূম যেন শক্তি আরাধনার কেন্দ্রস্থল। ৫১ সতীপীঠের মধ্যে পাঁচটি সতীপীঠ বাংলার এই জেলাতেই অবস্থিত। আবার দশমহাবিদ্যার এক দেবী তারার উপাসনাস্থল তারাপীঠও বীরভূমে। বাংলার পশ্চিমে এই জেলার পাঁচটি সতীপীঠের মধ্যে অন্যতম একটি হল ফুল্লরা সতীপীঠ। বীরভূম জেলার লাভপুরে অবস্থিত এই সতীপীঠ। কথিত আছে, এখানেই সতীর অধর বা নিচের ঠোঁট পতিত হয়েছিল।
সতীর ঠোঁটের স্পর্শে
কুজ্জিকাতন্ত্র ও পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে, এই পীঠ মহাপীঠ। শিবসংহিতায় ফুল্লরাকে দেখা যায় মহাপীঠ হিসেবেই। কিন্তু তন্ত্র চূড়ামণি এবং শিবচরিতের মতে, এই পীঠ আদতে একটি উপপীঠ। ফুল্লরাতেই দেবীর ঠোঁট পড়েছিল কি না সেই নিয়ে মতভেদও রয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে, পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের কাছে অট্টহাসে দেবীর ঠোঁট পতিত হয়েছিল। তাই আসল পীঠ অট্টহাসই। অনেকে ফুল্লরার সঙ্গে অট্টহাস নামটি উচ্চারণ করেন এই কারণে। ‘ফুল্লরা-অট্টহাস’ এমন নামকরণ কেন? এর জন্য ফিরে দেখতে হয় বহু শতাব্দী আগের এক কাহিনি।
আরও পড়ুন - বাংলার সতীপীঠের সবকটি কাহিনি এই লিঙ্কে
বশিষ্ঠ মুনির বংশধর
কথিত আছে, তারাপীঠে আদিকালে বশিষ্ঠ মুনি সাধনা করতেন। পরবর্তীকালে সেখানে বামাখ্যাপা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। এই বশিষ্ঠ মুনিরই বংশধর ছিলেন অট্টহাস। তাঁর সাধনক্ষেত্র ছিল লাভপুরের ফুল্লরা। মনে করা হয় এখান থেকেই ‘ফুল্লরা-অট্টহাস’ শব্দবন্ধের উৎপত্তি। সতীপীঠের স্থান নির্ণয় নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক ডি. সি সরকার। তাঁর মতেও, বীরভূম জেলার লাভপুরের এই অঞ্চলটিই অট্টহাস সতীপীঠ।
আরও পড়ুন - পুজো হয় ৫১ কুমারীর! তীব্র গরমেও শুকোয় না কুণ্ডের জল? এই সতীপীঠের কাহিনী জানেন?
মাঘী পূর্ণিমার বিশেষ পুজো
প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার দিনে মহাধুমধামে এখানে দেবীর পুজো হয়। সাধারণ শক্তির মহাযজ্ঞ ও আরাধনা অমাবস্যায় করা হয়। মাঘের পূর্ণিমা বেছে নেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন কৃষ্ণানন্দ গিরি নামের এক সন্ন্যাসী। গয়ার শঙ্করাচার্য মঠে থাকাকালীন তিনি এক রাতে স্বপ্নাদেশ পান মায়ের থেকে। তার পরেই এখানে মাঘী পূর্ণিমার দিনে এসে পৌঁছান। যোগ দেন মাতৃ আরাধনায়। তখন থেকেই এই পুজোর রীতি।
সামলাবাদের শেষ রাজা
লাভপুরের নাম তখন সামলাবাদ। সামলাবাদের শেষ রাজা ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ দিনমনি সিংহ। কথিত আছে, ফুল্লরা পীঠে প্রথম বড় আকারের পুজো তিনিই শুরু করেছিলেন। তার বহু পরে এসেছিলেন কৃষ্ণানন্দ। তবে বাইরের শত্রুর আক্রমণে মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল অনেকটাই। পরে দালান রীতিতে ফের মন্দিরটি তৈরি করা হয়। মন্দিরের গাত্রে টেরাকোটার ফলক। তাতে খোদাই করা কৃষ্ণলীলার নানা প্রতিকৃতি। মন্দিরের চূড়া ত্রিকোণাকৃতি। দুদিকে দুটি সিংহ এবং মাঝখানে ধ্যানরত মহাদেব।
হনুমানের পদ্ম সংগ্রহ
মন্দিরের সামনে নাট মন্দির। নাট মন্দিরের পরেই একটি দীঘি। দেবীদহ বা দলদলি নামে পরিচিত এই জলাশয়। শোনা যায়, এই দীঘির জল কখনও শুকোয় না। শ্রীরামচন্দ্র তখন মায়ের অকালবোধন করবেন। পুজোয় প্রয়োজন একশো আটটি পদ্মের। কথিত আছে, হনুমান এই দীঘি থেকেই একশো আটটি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন।
আরও পড়ুন - বাংলার এখানেই মন পড়েছিল সতীর? দেশবিদেশের পর্যটকদের কাছে আজও অমোঘ আকর্ষণ এই শক্তিপীঠ
দেবী অধরেশ্বরী
মন্দিরের প্রবেশমুখে রয়েছে একটি হাঁড়িকাঠ। গর্ভগৃহে রয়েছে একটা বড় আকারের শিলার উপরিভাগ। অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো দেখতে এই শিলার সম্মুখভাগ ঠোঁটের মতো। ওই শিলাই দেবী ফুল্লরা হিসেবে পূজিত হন। দেবীকে এখানে জয় দুর্গা ধ্যানে পুজো করা হয়। স্থানীয়দের মুখে পূজ্যা অধরেশ্বরী দেবী নামেও পরিচিত। দেবীর ভৈরব বিশ্বেশো বা বিশ্বেশ্বর।
পীঠনির্ণয় তন্ত্র মতে,
“অট্টহাসেচোষ্ঠপাতো দেবী সা ফুল্লরা স্মৃতা।
বিশ্বেশো ভৈরবস্তত্র সর্ব্বাভীষ্ট প্রদায়কঃ।।"
দেবীর পুজো ঘিরে উৎসব
মাঘী পূর্ণিমায় বিশেষ পুজোর সময় ১০-১২ দিনের মেলা বসে এই মন্দিরের প্রাঙ্গণে। রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্তের ভক্তরা এখানে এসে পুজো দেন। মাকে প্রতিদিনই অন্নভোগ দেওয়ার রীতি। অন্নভোগে মাছের টক পরিবেশন করা হয়ে থাকে। মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে ভোগ ঘর, ভোগ খাওয়ার ঘর। রয়েছে পানীয় জল ও সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা। প্রায় ৬৬ বিঘা জমিতে তৈরি এই মন্দিরের আশপাশ আগে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, জনবসতিহীন। বর্তমানে জনবসতি হলেও তা খুব অল্প। রামচন্দ্রের কথা স্মরণ করে এই এলাকায় প্রথমে অধরেশ্বরী দেবীর মন্দিরে সন্ধিপুজো হয়। এখানের সন্ধিপুজো হলে তবে অন্যান্য মন্দিরে শুরু হয় সন্ধিপুজো।