আজ বিধানসভায় বিধায়করা কেঁদে ভাসালেন। তবে সেটা শাসক–বিরোধী দু’পক্ষই। চোখের জল বাঁধ মানছে না বিধায়কদের। কারণ আজ থেকে আর সেই রসিক লোকটাকে পাওয়া যাবে না বিধানসভা কক্ষে। আর কেউ জিজ্ঞাসা করবে না কেমন আছিস রে? শীতকালীন অধিবেশনে তাঁর থাকা হল না। তিনি সবার প্রিয় সুব্রত দা। হ্যাঁ, প্রোটেম স্পিকার সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি প্রয়াত হয়েছে মানতে পারছেন না শাসক–বিরোধী পক্ষের বিধায়করা। সহকর্মীদের অধিকাংশ তাঁর চেয়ে অনেক নবীন। তবু, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথা বলতে উঠে মন কেঁদে ভাসালেন সকলেই। সপ্তদশ বিধানসভায় সুব্রত মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন সবচেয়ে প্রবীণ বিধায়ক৷ প্রোটেম স্পিকার হিসাবে বিধায়কদের শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন তিনি। সোমবার সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বিধানসভা অধিবেশন কক্ষে শোকপ্রস্তাব পাঠ হল। আর সেখানেই যেন না থেকেও শাসক–বিরোধীকে মেলালেন প্রয়াত দাপুটে নেতা–মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আজ পার্থ চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন— সুব্রতদাকে নিয়ে আজকে কিছু বলতে হবে আর তাঁর আসন ফাঁকা এটা মেনে নেওয়া কঠিন। নাকতলার পাড়ায় আড্ডা দিচ্ছি। শোভনদেব দা ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে বলল ছাত্র পরিষদ করবি? আমার দুটো জিনিস চোখের সামনে ভাসছে। প্রিয়দা সুব্রত দা দুজনে বসুশ্রী সিনেমায় আসতেন আড্ডা দিত। বসন্ত কেবিন থেকে খাবার আসত। আন্দোলন করতে গিয়ে মারও খেয়েছি। প্রিয়দা–সুব্রতদা কখন, কি করবে কেউ জানত না। ছাত্র আন্দোলনে সুব্রত দার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। সুব্রত দা শুধু রাজনীতির গুরু ছিলেন না। বাড়ির বড়দা ছিলেন। আমার মা মারা গেল। বাড়িতে এলো। কত কথা বলল। চার মাসের মধ্যে নিজেও চলে গেল। আমায় বলত মমতা গরীবের মেয়ে ওকে উঠতে দে। সংগ্রামী নেতা না থাকলে সংগ্রামী নেত্রী তৈরি হয় না। সহকর্মী ফিরহাদ হাকিম বললেন— বিরোধী রাজনীতি করতে এসে সুব্রত দা’র ঘর চিনেছি। সুব্রত দা আমার চোখে হিরো। আমি উত্তমকুমারকে দেখিনি৷ সুব্রত দা আমার চোখে উত্তমকুমার। প্রথমে কাছে যাওয়ার সাহস হতো না। দেখতাম হিরো আসছে। কাউন্সিলর হয়ে আমি সুব্রত দা’কে পেয়েছি। উনি তখন মেয়র ছিলেন। সুব্রত দা’র সঙ্গে কাজ করার সাহস পেয়েছি। আজ বিশ্বাস হচ্ছে না, সুব্রত দা নেই।এই বিষয়ে মানস ভুঁইয়া বললেন— সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়ে কী সব কাণ্ড ঘটেছে। মহাজাতি সদনে যেতাম। দেখতাম প্রিয়–সুব্রত চা বানাচ্ছে। বললাম ছাত্র পরিষদ করব। সুব্রতদা বলল সত্যি করবি? আমার বাবা মারা গেল। খবর দিতে পারিনি। কোথা থেকে খবর পেয়ে বাড়িতে বৌদিকে নিয়ে হাজির। বুকে আগলে রাখত। জড়িয়ে রাখত। রাজনীতির উর্ধ্বে সম্পর্ক ছিল। বাংলার রাজনীতিতে সুব্রত দা’কে বাদ দিয়ে কোনও আলোচনা সম্ভব নয়। স্পিকার মহোদয়কে বলব বিশেষ কিছু করা যায় কি না দেখবেন। বিজেপির বিধায়ক মিহির গোস্বামী বললেন—প্রিয়–সুব্রত দার হাত ধরে আমার ছাত্র রাজনীতিতে আসা। উনি আমার পরিবারের লোক হয়ে ছিলেন। কলকাতায় এলে সুব্রত দার বাড়িতে দেখা করব না এটা আমার কাছে পাপবোধ ছিল। বিধায়ক হয়ে শপথ নিয়ে প্রণাম করলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম একটু আশীর্বাদ নেব। ফেরাননি। বরং পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ভাল করে প্রণাম কর।রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বললেন— আমি তাঁকে প্রণাম জানাই৷ আমি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। আমার ও আমার পরিবারের আত্মিক সম্পর্ক ছিল তাঁর সঙ্গে। ইন্দিরা গান্ধীর সভায় আমি তাঁকে প্রথম দেখি। বহুবার বাড়িতে এসেছেন। আমরা পরিবারের মানুষকে হারালাম। রাজনীতির বাইরেও সম্পর্ক ছিল। আমাকে স্নেহ করতেন। যতদিন রাজনীতি থাকবে এই বাংলায় সুব্রত দা প্রাসঙ্গিক থাকবেন। আমাকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে ছিলেন। এটা বড় বিপর্যয়।