শাসকের হার নিশ্চিত। গ্রামে গ্রামে নিঃশব্দে মানুষ তৈরি বিরোধীদের জয়যুক্ত করতে। মিডিয়ায় এরকম কার্যত একটা হাওয়া উঠে গিয়েছিল যে পরিবর্তন নেহাতই সময়ের অপেক্ষা। ইভিএম খুলতে বাস্তব যদিও অনেকটাই অন্য বলে প্রকাশ পেল। কি ভাবছেন এবারের ভোটের কথা বলছি তো। এবারের ভোটের জন্য কথাগুলি প্রাসঙ্গিক হলেও ঠিক দুই দশক আগে ২০০১ সালে কার্যত একই চিত্রনাট্য অভিনীত হয়েছিল বাংলার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে। তফাত, যে নেই তা নয়। সেবারের বিজিত নেত্রী যিনি হারের অভিঘাতে ঘরে কুলুপ এঁটেছিলেন, তিনি আজকের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। নন্দীগ্রামে ধাক্কা খেলেও বাংলার রাজনীতিতে যাঁর একচেটিয়া দাপট নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। দুই দশক আগের কথায় ফিরলে সেবার এবারের সঙ্গে প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু মিল ছিল। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গড়ে আত্মপ্রকাশেই ১৯৯৮ সালের লোকসভায় তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মমতা। ১৯৯৯ সালে ফের পুনরাবৃত্তি করেন ভালো ফলের। তখনও অবশ্য বাম দুর্গ তিনি ভাঙতে পারেননি। মূলত কংগ্রেসের ঘাঁটিগুলিকে ধীরে ধীরে ঘাসফুলের বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্ক করে তুলছেন তিনি। এরমধ্যেই এল ২০০১ বিধানসভা ভোট। জ্যোতি বসুর লম্বা ইনিংসের পর সবে দায়িত্ব নিয়েছেন বুদ্ধবাবু। সেই হিসেবে তখনও তিনি আনকোরা। মওকা বুঝে তখন প্রচারে ঝড় তুললেন মমতা। কেশপুর থেকে চমকাইতলা, ঘরে ঘরে মানুষ এইসব নাম জানল দিদির সৌজন্যে। পাঁশকুড়া উপনির্বাচনে জয়ের থেকেই উঠল মিডিয়ায় প্রচারের সুনামি। কিছুটা হলেও মমতাও হয়তো ভেবেছিলেন ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মায় তিনি বামেদের সংগঠনকে টেক্কা দিতে পারবেন। স্লোগান উঠল চুপচাপ ফুলে ছাপ দেওয়ার। ভোটের ঠিক আগে কংগ্রেসের হাত ধরলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধা হল না। বামদুর্গে ভেদ করতে পারলেন না তিনি। সেবার ৬০টি আসন পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তৃণমূলকে। কংগ্রেস পায় ২৬। অপরপক্ষে বামফ্রন্ট জেতে ১৯৬ আসন। কংগ্রেস-তৃণমূল মিলিয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পায়। এবারের ফল সেদিক থেকেও প্রায় দুই দশক আগের প্রতিবিম্ব। ২০১৯ সালে নমো ঝড়ে লোকসভায় ১৮টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। ৪১ শতাংশ ভোটও পেয়েছিল। কিন্তু সেই মোমেন্টামটি ধরে রাখতে পারল না গেরুয়া শিবির। লোকসভা থেকে ভোটও কমেছে, পাল্লা দিয়ে কমেছে আসন, সেই নিরিখে। যদিও ২০১৬-র হিসেব টানলে উল্কার গতিতে বিজেপির উন্নতি হয়েছে। তাই হাল ছেড়ে দেওয়ার বা হতাশ হওয়ার নিশ্চিত ভাবেই কিছু নেই। কিন্তু হাওয়াকে বাস্তবে ঝড়ে পরিণত করতে গেলে অনেকটা পথ এখনও অতিক্রম করতে হবে বিজেপিকে। তৃণমূলের ক্ষেত্রে অন্তত নেতৃত্বের প্রশ্নের উত্তর ছিল। বিজেপির সেটিই প্রথম অন্তরায়। শহুরে বাঙালির কাছে যে দিলীপ ঘোষ বা বাবুল সুপ্রিয়ের তেমন কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই, এবারের ভোট সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সাংগঠনিক ভাবেও বিজেপির দুর্বলতা বেআব্রু হয়ে গিয়েছে এই ভোটে। উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলে কিছুটা সংগঠন দানা বাঁধলেও বিস্তীর্ণ দক্ষিণবঙ্গে কার্যত তার নামগন্ধ নেই। এই সমস্যা একদা তৃণমূলেরও ছিল। ২০০৬ সালের ভোটে মুখ থুবড়ে পড়ার পর মুকুল রায়ের সাহায্যে সংগঠন ঢেলে সাজান দিদি। কিন্তু তাঁর সেই প্রচেষ্টায় বড় অক্সিজেন জুটিয়েছিল সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। বাংলায় যখনই সরকার বদলেছে, তার প্রেক্ষাপটে রয়েছে বড় কোনও ঘটনা, যা নাড়িয়ে দিয়েছে জনগণকে। এবারের ভোটে সেরকম কোনও ইস্যু ছিল না বিজেপির কাছে। সাম্প্রদায়িকতার তাস বা তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়েই বারবার তাই আক্রমণ শানিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। আগামী দিনে হয়তো মিলবে তেমন ইস্যু, হয়তো গেরুয়া হবে বঙ্গ। কিন্তু ততদিন অবধি দিল্লির নেতাদের কথায় নয়, দুয়ারে যাকে পাওয়া যাবে, সেই আটপৌরে দিদির ওপরই ভরসা রাখবেন আম বাঙালি।