রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বেলভিউ হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। বয়স হয়েছিল ৮৫ বꦛছর। বয়সজনিত নানান সমস্যার মধ্যে দেখা দিয়েছিল ♓শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ও মূত্রনালীতে সংক্ৰমণ। কিছুদিন আগে ফের ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। রবিবার রাতে থামল লড়াই। না ফেরার দেশে পা বাড়ালেন 'ঋজুদা'-র স্রষ্টা।
বুদ্ধদেববাবুর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বাংলার সাহিত্যমহল। প্রবীণ থেকে নবীন বাংলার প্রায় সব সাহিত্যিকেরই পছন্দের লেখকের তালিকায় একেবারে উঁচুর দিকেই তাঁর অবস্থান। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের মতো যশস্বী সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধুই সাহিত্য বন্ধুর ছিল না। ছিল আত্মিক। সমরেশ মজুমদার তাঁর থেকে প্রায় বছর আট, নয় ছোট হল🌸েও তাঁদের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বয়স কখনও পাঁচিল তুলে দাঁড়ায়নি। সমরেশ মজুমদারের নিজের স্বাস্থ্যও দারুণ কিছু ভালো নেই। তবে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন লেখক। এর মধ্যেও ফোনের ওপার থেকে হিন্দুস্তান টাইমস-কে তাঁর 'লালাদা'-র বিষয়ে নানান রঙিন, অজানা কথা শোনালেন 'কালবেলা'-র স্রষ্টা।
কথায় কথায় জানা গেল নামকরা সাহিত্যিক হয়ে ওঠার আগেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বুদ্ধদেব গুহ-র। সেই স্বল্প পরিচয়ে চাকরির জায়গায় রীতিমতো একটি বিপদের হাত থেকে তাঁকে প্রায় একা হাতে বাঁচিয়েছিলেন 'ঋজুদা'-র স্রষ্টা। সমরেশ মজুমদারের কথায়, ' লালাদার কাছে আমি আজীব♚ন ঋণী থাকব সেই উপকারের জন্য। তখন আমি সদ্য ইনকম ট্যাক্স-এর চাকরিতে ঢুকেছি। তখন লেখালিখি করি না বললেই চলে। ওই একটা-দুটো গল্প প্রকাশিত হয়েছে দেশ পত্রিকায়। লালাদা তখন ইনকাম ট্যাক্স এর বড় উকিল। এমন সময় একটি গন্ডগোলের ফলে পুলিশের ভুল রিপোর্টে আমার চাকরি গেল। রুল ফাইভ ওয়ান-এর ধারায় আমার নামে অভিযোগ উঠল। এই অভিযোগ উঠলে আর কোনও সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না। লালাদার কানে ব্যাপারটা গেছিল। উনি নিজেও ততদিনে এক দারুণ জনপ্রিয় লেখক। আমি যেহেতু দু' একটা গল্প লিখেছি দেশ পত্রিকায় সেই সুবাদে স্নেহব🌟শত আমাকে ইনকাম ট্যাক্স বিল্ডিংয়ে অফিসে দেখা করতে বলল। গেলাম। সব বললাম। লালাদা শুনে করলেন কী সোজা ইনকাম ট্যাক্স কমিশনারের কাছে নিয়ে গেলেন। বললেন যে ওঁকে এক মাস সময় দেওয়া হোক। এই এক মাসের মধ্যে যে পুলিশ তাঁদের রিপোর্ট উইথড্র করে তাহলে তো সমরেশের চাকরি ফিরিয়ে দিতে অসুবিধে নেই। সব শুনেটুনে ওঁরা রাজি হল। তারপর এক মাসের মধ্যে পুলিশ রিপোর্ট উইথড্র করল আর আমিও চাকরিটা ফিরে পেলাম'।
এই ঘটনার পরপরই ধীরে ধীরে হৃদ্যতা বাড়ল এই দু'জনের। সেই শুরু। সামান্য থেমে 'অর্জুন'-এর লেখকের গলায় উঠে এল বুদ্ধদেব গুহর আরও নানান কথা। ' তখন আমি সাহিত্য আকাদেমি পেয়ে গেছি। এদিকে আমার সিনিয়র লেখকরা তখনও কেউ পাননি। সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদা, বুদ্ধদেব গুহ কেউ নন। তা আমাকে উনিই প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। দরাজ দিল তো। সঙ্গে আবার মজা করে বলছিলেন, 'কী সমরেশ এরমধ্যেই আকাদেমি পেয়ে গেলে। কই আমরা তো এখনও পাইনি!' এসব শুনে আমি তো অপ্রস্তুত। তা এরকমই ছিলেন আমার লালাদা। যা মন𝕴ে আসত মুখের ওপর বলে দিতেন। রোজ আড্ডা হতো না ঠিকই তবে আত্মিক সম্পর্ক ছিল।
আর মজা। ওরে বাবা! মজা করতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। একটা ঘটনা বললে বুঝতে পারবেন। একবার দার্জিলিং থেকে ফিরছেন উনি। বৃষ্টির মধ্যে ওঁর জিপটা উল্টে গেল। অল্প চোট পেলেও তেমন ক্ষতি হয়নি। এবার এই ঘটনা নিয়ে একটি কলামে তিনি মজা করে লিখলেন, 'এটা ষড়যন্ত্র। আর এর পিছনে রয়েছে সমরেশ মজুমদারের হাত!' তারপর এটা ছাপাও হল কাগজে! ভাবতে পারছেন। আমি তখন এর বিন্দুবিসর্গ জানি না। এরপর ফোন পেতে শুরু করি। অজস্র লোক ফোন করে আমাকে এটা সেটা বলা শুরু করলꦇেন। আমি তো শুনে হাঁ। কোথাও বেরোতে পর্যন্ত পারছি না লজ্জায়। কেউ কেউ ওঁর বিরুদ্ধে আমাকে উসকিয়েছিল। তবে আমি তাতে পা বাড়াইনি। তো আমি গিয়ে লালাদাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কী লিখেছ? প্রশ্ন শুনে শিশুর মতো দ💞ুষ্টু হেসে বলল, 'আরে একটু মজা করলাম আর কী!' শুনে হতভম্ব হয়ে আমিও একটু দুষ্টুমি করে বলেছিলাম, এটা মজা? এইজন্যই তুমি বড় লেখক হতে পারলে না। শুনে খুব মজা পেয়েছিলেন উনি।
প্রিয় লালাদার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফোনের ওপারে তখন বর্ষীয়ান লেখকের গলায় দুঃখ মেশানো হাসি। ফের বলে উঠলেন, 'আরও একটা বলি। একবার আমি, সুনীলদা আর লালাদা তিনজনে মিলে চা বাগানে গেছি। ওই ডুয়ার্স অঞ্চলে। দেদার খানাপিনা , আড্ডা চলছে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ল। ওঠার সময় হয়ে এল। ꧒সন্ধ্যেবেলা চা বাগানে মাঝেমধ্যেই চিতাবাঘ বেরোয়। নানারকম বিপদ। ওমা, খেয়াল হতে দেখি লালাদা নেই। খোঁজ খোঁজ। কোনও পাত্তা নেই। এদিকে তখন চিন্তা শুরু হয়েছে আমাদের। সুনীলদাও খোঁজাখুঁজি করছেন। এমনা সময় চা বাগানের কুলি কামিনদের একটা বꦑস্তি থেকে শুনি কে যেন টপ্পা গাইছে। গলাটা কেমন যেন চেনা চেনা। সন্দেহ হতেই এগিয়ে যাই।
গিয়ে দেখি ঝুপড়ির মধ্যে টিমটিমে আলো জ্বলছে। আর পায়ের ওপর পা তুলে দরাজ গলায় গান ধরেছেন লালাদা। আর ওঁকে ঘিরে প্রায় হাতজোড় করে বসে রয়েছে কয়েকজন চা বাগানের নেপালি কর্মী, কুলিরা। দেখে তো আমি অবাক। বেশ জোরেই ডাক দিয়ে প্রায় হাত ধরে বললুম, কী করছেন আপনি! আর সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে আপনাকে। সুনীলদা পর্যন্ত টেনশনে মরে যাচ্ছে। সব শুনেটুনে আমাকে হেসে বললেন, ওহ! চলে এসেছ তুমি? এই একটু গান গাইতে ইচ্ছে করল, তাই গাইলাম। ওঁদেরও শোনালাম। তা কী এমন ক্ষতি করেছি বাপু?' আর আমি মনে মনে ভাবছি এদিকে শ্রোতারা বাংলা ভাষা বোঝে না। তা কে শোনে কার কথা। এই ছিল আমার লালাদা!' বলে হাসা শুরু করলেও মাঝপথ𝓀ে থেমে 'মাধবীলতা'-র স্রষ্টা আস্তে আস্তে বলে উঠলেন, 'এরকম কত স্মৃতি রয়েছে। বিশ্বাসই হয় না এই মানুষটাও চলে গেল চিরতরে। আর দেখতে পাব না কোনওদিন। ওঁর ভরাট গলায় হাসি শুনতে পারব না'। 'দৌড়'-এর লেখকের গলার স্বরে তখন শেষ বিকেলের আলোর মতো মনখারাপ চুঁইয়ে পড়ছে।