খুলনার কলাপোতা গ্রাম, পদ্মাপাড়ের মেঠো গন্ধ, বৃষ্টিভেজা কচুবন, আমবাগান, আর তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ইন্দুবালার বাল্য প্রেম। বাবা-মা-ঠাম্মার আদরের ইন্দুবালা বিয়ের পর দেশ ছাড়লেন, স্বামীর হাত ধরে এলেন কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের দোতলা বাড়িতে। সঙ্গে নিয়ে এলেন শুধু স্মৃতির পাহাড়। শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্ছনা দিয়েই অভ্ꩲযর্থনা হল 'ইন্দু'র। নাহ, স্বামী রতনলাল মল্লিকও পাশে ছিলেন না। খোলা বাতাসে পাখির মতো উড়ে বেড়ানো ইন্দুবালার জীবনটা এক ঝটকায় বদলে গেল। অসুখী দাম্পত্যের মধ্যে দিয়ে শুরু হল ইন্দুবালার লড়াই, পাশে ছিলেন শুধু মাছওয়ালি লছমী। অল্পবয়সেই স্বামী চোখবুজলে সংসারের হাল ধরেন ইন্দুবালা, দুই সন্তানকে বড় করে তোলার সঙ্গে 'খোলেন ইন্দুবালা ভাতের হোটেল'। তবে সেই পথটিও দেখিয়েছিলেন লছমী-ই।
ধীরে ধীরে ছেনু মিত্তির লেনের সেই 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল'র পসার বাড়ে, হোটেলের মেনুর সঙ্গে মিলে মিশে যায় ইন্দুবালা মল্লিকের স্মৃতিপট। অগোছালো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেসমস্ত স্মৃতি সাজিয়েগুছিয়ে নিজের মধ্যে সযত্নে লালন করে চলেন ইন্দুবালা। ঠাম্মার শেখানো রান্নার প্রতি ভালোবাসা তো আছেই, তবে তার থেকেও 'ইন্দু'র মনের টান স্মৃতিদের সঙ্গেই বেশি বাঁধা। কঠিন জীবনে আস্তে আস্তে কাছের মানুষগুলিকে হারিয়ে ছেনু মিত্তির লেনে আসলে স্মৃতিদের সঙ্গেই সংসার পেতে বসেন ইন্দুবালা। একাকীত্বকে ভালোবেসে দূর ঠেলেন সন্তানদেরও। স্মৃতির সরণি বেয়ে সেই বাড়িতেই তৈরি করেন একটুকরো কলাপোতা গ্রাম। ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’এর প্রথম সিজনের গল্প ইন্দুবালার স্মৃতিদের হাত ধরেই তুলে ধরেছেন পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য। যে স্মৃতিপট, ইন্দুবালা জীবনের লড়াই, কাছের মানুষদের হারিয়ে তাঁর একা হয়ে যাওয়া চোখ ভিজিয়ে দেয়। ইন্দুবালার দীর্ঘশ্বাসের মতোই চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে জল। সিরিজটি দেখতে দেখতে ইন্দুবালার জীবনের গলিতে কখন যে ঢুকে পড়লাম তা ঠিক খেয়াল করতে পারি নি। কিশোরী, মধ্যবয়স্কা এবং বৃদ্ধা ইন্দুবালা, জীবনে তিনস্তরে তাঁর গল্প বলেছেন পরিচালক। তবে তাতে গল্পের পথ চলা কোথাও হোঁচট খায়নি। সুন্দরভাবেই এগিয়েছে। বরং মনে হয় চোখের সামনেই যেন সবকিছু ঘটে চলেছে। সবথ🌠েকে বেশি মন ছুঁয়ে যায় দেশে না ফিরতে পারার যন্ত্রণা বুকে বেঁধে পাসপোর্টের একটা একটা পাতা ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি। আঘাত করে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পরই ছোট্ট ইন্দুবালাকে তাঁর শাশুড়ির লাঞ্ছনা, 'রিউউজি' বল⛄ে বারবার আক্রমণ, স্বামী রতনলালের অত্যাচার।
যদিও গল্প বলা এখনও বেশকিছুটা বাকি। এখনও আরও কিছু লড়াই, ও কষ্ট পাওয়া বাকি রয়েছে ইন্দুবালার। সে গল্প জানতে ২৪ মার্চ পর্যন্ত আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে দর্শকদের। তবে প্রথম সিজনেই কল্লোল লাহিড়ীর লেখা উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই সিরিজটি দর্শকদের মনে কাছাকাছি পৌঁছতে সফল পরিচালক দেবলায় ভট্টাচার্য। আর 'ইন্দুবালা' হয়ে আরও একবার অভিনেত্রী হিসাবে নিজের জাত চেনালেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, যোগ্য সঙ্গত করেছে সোমনাথ কুণ্ডুর মেকআপ। তবে তারপরেও সিরিজের শুরুর দিকে ক্যামেরার ক্লোজ সটে কোথাও কোথাও শুভশ্রীর মুখের মেকআপটা যেন বড়বেশি ধরা পড়ছিল। পরবর্তী অংশগুলিতে অবশ্যে সেটা মনে হয়নি। বিশেষ করে তাঁর হাতের মেকআপ প্রশংসনীয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে শুভশ্রীর গলার স্বর বদলে যাওয়া, হাঁটাচলা কোনওখানে বৃদ্ধা হিসাবে তাঁকে দেখে বিন্দুমাত্র সংশয় জাগেনি। এককথায় অনবদ্য অভিনয়। বৃদ্ধা বয়সেই 'ইন্দুবালা' শুভশ্রীকে বেশি পারফেক্ট মনে হয়েছে। তবে শুধু শুভশ্রী-ই নন, কিশোরী ইন্দুবালা হয়ে অভিনয়ে ভীষণভাবে সপ্রতিভ পারিজাত চৌধুরী। তার পদ্মাপাড়ের বাংলা ভাষায় কথা বলা, উচ্চারণ কোথাও বেখাপ্পা লাগেনি। কিশোরী ও পরিণত ইন্দুবালাকে সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিতে সফল পরিচালক দেবালয়। প্রশংসার দাবি রাখেন স্নেহা চট্টোপাধ্যায়ও। এছাড়াও প্রতীক দত্ত, মিঠু চক্রবর্তী, অঙ্গনা রায়, দেবপ্রতীম দাশগুপ্তের অভিনয়ও মন কাড়ে। ভীষণভাবেই প্রশংসার দাবি রাখে সিনেমাটোগ্রাফার রম্যদ𒁃ীপ। তাঁর ক্যাম꧋েরার কারিকুরিতে যেন গল্পটি আরও বেশি করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রশংসার দাবি রাখে সিরিজের সম্পদক সংলাপ ভৌমিক। কারণ, সঠিক সম্পাদনা ছাড়া কোনওভাবেই গল্পকে মসৃণভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। এটায় গোলযোগ থাকলে পরিচালককেও হোঁচট খেতে হয় বৈকি। তবে এক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
সবশেষে মন ছুঁয়ে যায় ‘ইন্দুবালা ভাতের হোট⛦েল’ সিরিজের গান। ইমনের গাওয়া 'পাখিদের স্মৃতি' দর্শকদের ইমোশনকে গল্পের পথ চলার সঙ্গে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে সফল। রেডিওতে বাজা বাঁশির সুরে পুরানো সেই দিনের কথা গানটি শুরুতেই সিরিজের সঙ্গে দর্শকদের বেঁধে ফেলেছিল। সবকিছুই ঠিকভাবে এগোলেও এমন একটি আবেগপ্রবণ গল্পের জন্য দ্বিতীয় সিজনের অপেক্ষা করা, যেন ছন্দপতন ঘটায়। তবু উপায় নেই, বাকি কথা জানতে, ফের স্মৃতিদের ভিড়ে মিশতে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে ২ মার্চ পর্যন্ত।