তবে ‘রবিবার ছুটির দিনেও কাজ! টক্সিক বসকে না বলতে শিখুন’। 'আমার বস' মুক্তির বহু আগে ছবির পোস্টারে এমনই বার্তা দিয়েছিলেন পরিচালক জুটি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়। আর এবার নিজেই 'বই প্রকাশনা সংস্থা'র কড়া বস অনিমেষ গোস্বামী হয়ে পর্দায় হাজির শিবপ্রসাদ। তবে আবার সেই অনিমেষ-ই কিনা বলছেন, ‘আমার বস’ আমার মা। আর উইন্ডোজ প্রোডাকশনের এই ছবিতে 'বসের বস' শুভ্রা গোস্বামী হয়ে ধরা দিলেন রাখি গুলজার। কিন্তু ছবিতে কেমন ছিল এই দুই 'বস'-এর রসায়ন?
ছবির গল্প
ধরুন, আপনি অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে, আর সেই সময়ই এল মায়ের ফোন। ক্রমাগত রিং হচ্ছে, অগত্যা ফোনটা ধরলেন। আর তখনই মায়ের আবদার, ‘মাসির জন্য ট্যাক্সি বুক করে দে তো’। সেই মুহূর্তে মায়ের অবদারে বিরক্ত হলেও ফেলতে হয়তবা পারবেন না। এ ছবি আজকালকার চাকুরিজীবিদের কাছে অতি সাধারণ। কিন্তু এবার সেই মা-ই যদি আপনার অফিসে, আপনার সঙ্গে এসে হাজির হন, পাশে এসে বসেন, তাহলে?
পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে নাকি সহজ?
'বই প্রকাশনা সংস্থা' 'বস' অনিমেষ গোস্বামী (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়), যিনি কিনা নিত্যদিনই অফিসের কর্মীদের উপর ছড়ি ঘোরান, পান থেকে চুন খসলেই অপমান করেন, লেট মার্ক হলেই চটে যান, কর্মীদের ভালো কাজের প্রশংসা করতে জানেন না, তবে ভুল হলেই রেগে কাঁই। সেই অনিমেষের অফিসে একদিন হাজির তাঁর মা শুভ্রা গোস্বামী (রাখি গুলজার)। প্রথমে আপত্তি করলেও মায়ের অবদার ফেলতে পারল না ছেলে। ছেলের অফিসে কখনও ট্রেনি কর্মচারী হয়ে, কখনও আবার প্রুফ রিডার হয়ে কাজ সামলালেন তিনি, তবে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন 'বসের বস'। অফিসের যে কর্মচারীরা রাগী অনিমেষের কারণে সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকেন, তাঁদেরই বন্ধু হয়ে উঠলেন শুভ্রা দেবী। বলা ভালো, অশান্তির অফিসে কর্মচারীদের চাপ মুক্ত করলেন তিনি।
অফিস কর্মচারীদের উপর ছেলে অনিমেষের হম্বিতম্বিতে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াতে থাকলেন শুভ্রা গোস্বামী। ছেলের উদ্দেশ্যে তার বার্তা ‘এমপ্লয়ীদের কাছ থেকে কাজ বুঝবে, তার মনটা বুঝবে না?’
এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। কিন্তু অফিসের-ই একটা ফ্লোরে অফিস কর্মীদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের জন্য ক্রেশ খুলে বসলেন শুভ্রা দেবী। নাম দিলেন 'আশ্রয়'। মায়ের এমন ‘আজব কাণ্ড’ অনিমেষের কানে পৌঁছতেই সমস্যা শুরু। কর্পোরেট অফিসে সামাজিক দায়িত্ব পালনে নতুন উদ্যোগ নিতে চান শুভ্রা গোস্বামী। যা কিনা অত্যন্ত বিরল। অনিমেষ মাকে বোঝালেন, এদেশে বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলেমেয়েদের কাছে 'ব্য়াগেজ', তাই তাঁর এমন ভাবনা একেবারেই ফ্লপ। কিন্তু তারপর? কোন পথে এগোবে মা-ছেলের এই মত বিরোধ? তা না হয় আর নাইবা বললাম, তাহলে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়।
তবে বলে রাখি, এই গল্পে আরও একটি দিক আছে। যেখানে উঠে এসেছে অনিমেষ ও মোসুমীর (শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়) প্রেম, বিয়ে, দ্বন্দ্ব, বিরহের ছবি। আর ছেলে-বউমার এই সম্পর্কের টানাপোড়েনেও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে শুভ্রা দেবীর। তবে সেটা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক সেটা বরং প্রেক্ষাগৃহে গিয়েই দেখুন। সবটা দিলে তো স্পয়লার হয়ে যায় যে।
পর্যালোচনা ও অভিনয়
দীর্ঘ ২২ বছরের অপেক্ষা। এত বছর পর বাংলা ছবিতে ফিরে রাখি গুলজার যে আবারও মন ছুঁয়ে গেলেন তা বলাই বাহুল্য। কোথাও মনে হল না তিনি অভিনয় করছেন। শুভ্রা গোস্বামীর চরিত্রটা জীবন্ত করে তুলেছেন রাখি। আর তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন ছেলে অনিমেষ অর্থাৎ শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এক কথায় তিনিও অনবদ্য। ছবিতে মন কাড়ে ছবিতে মা-ছেলের খুনসুটির দৃশ্য। কবিতার লড়াই। এসবই দর্শকদের মুখে হাসি ফোটাবে বৈকি। তবে আবার বহু দৃশ্যই নিজের অজান্তেই আপনার চোখের পাতা ভিজিয়ে দেবে। অফিস-বাড়ির ঝক্কি সামলাতে গিয়ে হিমসিম কর্মচারীদের সঙ্গে বহু চাকুরিজীবীই হয়ত নিজের পরিস্থিতিও মিলিয়ে নিতে পারবেন। মন কাড়ে শ্রাবন্তী-শিবপ্রসাদের কাব্যিক প্রেম। যদিও এই গল্পে তাঁদের রসায়নের থেকেও বেশি মা-ছেলের রসায়নকেই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই কখনও মনে হয়েছে, এই প্রেম-বিরহটাও আরেকটু জমিয়ে দেখালে হয়ত মন্দ হত না।
ছবিতে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় নিজ চরিত্রে সাবলীল, যদিও এখানে যে তাঁর খুূব বেশিকিছু করার ছিল না। দক্ষিণী কর্মচারীর ভূমিকায় নজর কেড়েছেন কাঞ্চন মল্লিক। তাঁর চরিত্র, বাচন ভঙ্গী কৌতুকরস অনেক জায়গায় তৈরি করে। তবে আবার কূট কাচালিতেও তিনি সেরা। অন্যদিকে নিজ নিজ চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন শ্রুতি দাস, সৌরসেনী মৈত্র, গৌরব চক্রবর্তী, আভেরি সিংহ রায়, ঐশ্বর্য সেন, উমা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অন্যান্যরা। এই ছবির হাত ধরে বহু বছর পর পর্দায় দেখা গেল অভিনেতা ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তবে যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন সাবেত্রী চট্টোপাধ্যায়। ছোট্ট চরিত্রে মন স্পর্শ করে গিয়েছেন তিনি। 'ঝুগড়ুটে' চরিত্রে তিনি অসাধারণ। সবথেকে বেশি ভালো লাগে লুডো খেলতে খেলতে রাখি ও সাবিত্রীর মতো দুই কিংবদন্তির খুনসুটি। আর সেটা অবশ্যই 'আমার বস'-এর হাত ধরে বাংলা ছবির দর্শদের কাছে একটা বড় পাওনা। প্রথমবারের জন্য পর্দায় একসঙ্গে ধরা দিলেন তাঁরা।
ছবির গল্প ছিমছাম, তাই এখানে ক্যামেরার কারিকুরির বিশেষ জায়গা নেই। ছবি চিত্রনাট্য দর্শকদের কাছে ছবির বার্তা পৌঁছে দিতে সফল। গল্পের বাঁধন বেশ নিবিড়, কোথাও ক্লান্তিকর বা দীর্ঘ নয়। তাই 'শেষ হলে বাঁচি' এমনটা এক্কেবারেই মনে হবে না। সব মিলিয়ে শিবপ্রসাদ ও রাখি গুলজার-এর 'আমার বস'-কে ১০এর মধ্যে ৯ দেওয়া যাক।