তথাগত মুখোপাধ্যায়না, আমি কোনও যুদ্ধ দেখিনি। আমি দেখিনি যুদ্ধ প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার পরিবার আত্মীয় স্বজনের মৃতদেহ । আমি দুর্ভিক্ষ দেখিনি । বম্বিং হলে কোথায় লুকোতে হয়, আমি জানি নไা। সাইরেনের শব্দে আমার ভয় করে না। তাই আমি স্বাধীনতা দেখিনি। স্বাধীনতা কাকে বলে, আমি জানি না। আমরা জানি না।বাড়িতে পতাকা ঝোলানো কিংবা দেশ সংক্রান্ত গান বাজানো দেশ বন্দনার প্রতীকী হতে পারে । স্বাধীনতার সাথে তো তার দূর দুরান্তের কোনও সম্পর্ক নেই। স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়। পাড়ার মাইকে চার বার ‘অ্যায় ওয়তন’ গান বাজালꦺে পাড়ার অংকের স্যারের হাত থেকেই স্বাধীনতা মেলে না তো দেশ! এই ডিজিটাল সময়ে প্রতিকী বিষয়টা আসলে প্রচারের শক্তিশালী অস্ত্র। আর দেশপ্রেম তো সেখানকার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পণ্য। সিনেমা থেকে সাহিত্য হয়ে দাঙ্গা অবধি দেশপ্রেম বেস্ট সেলার। কখনও কখনও কোনও কোনও দেশে তো বিক্রি বাট্টায় ধর্ম, ভগবান— এ সবকেও ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে দেশপ্রেম নামের সেন্টিমেন্ট।
দেশের জিডিপি তলানিতে,রোজকার পণ্যের দাম বাড়ছে, তেলের দাম আকাশ ছোঁয়া,ডলারের ব্যবধান বাড়ছে ক্রমশ। তার মধ্যে বাড়িতে পতাকা ঝুলিয়ে শিশি করে দেশপ্রেমের সেন্টিমেন্ট বিক্রি হতে পারে, যা দিয়ে অক্ষয় কুমারের পরের সিনেমা সুপার ডুপার হিট হবে আর আমাদের দেশ হবে শ্রীলঙ্কা। দেখনদারি তাদেরই প্রয়োজন যাদের সত্যি আবেগটা নেই। নিউজল্যান্ড কিংবা সুইডেনের মানুষদের বাড়ির সামনে পতাকা ঝুলিয়ে প্রমাণ করতে হয় না তাঁদের দেশপ্রেম। দেশ তাঁদের এতটাই দিয়েছে যে আর অন্য কোনও প্রেমের অপশানটাই নেই। যে দেশে ২০২২ সালেও ২৪ কোটি বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, সে দেশকে তো ১৫ অগস্ট বাড়িতে বাড়িতে পতাকা ঝুলিয়ে প্রমাণ করতেই হবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হচ্ছে। যে দেশের শিক্ষককে জাতপাতের কারণে সামান্য জল খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে খুন করে, সে দেশে পতাকা না লাগানো দেশদ্রোহীতা।যে দেশে স্যুইম স্যুট পরায় চাকরি যায় শিক্ষিকার, সেই দেশে সিনেমা চলার আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো মাস্ট, তাতে উঠে দাঁড়ানো মাস্ট নইলে দেশ হেরে যাবে। পাকিস্তান জিতে যাবে।(আরও পড়ুন: রাস্তার ধারে পড়ে থাকে ‘বেনামী’ বিপ্লবীর দেহ, পাশ দিয়ে উড়ে যায় ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা: রাজা সেন)
আসলে ফূর্তিতে জন্মলগ্ন থেকে পড়ে পাওয়া এক সীমান্ত মানুষ জানতেই চায় না দেশ কী, দেশ মানে কী! দেশ মানে কোনও কাঁটাতারে ঘেরা ভূখন্ড নয়। একদল মানুষ পৃথিবীতে তাদের অবস্থানে কী ভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে,কী ভাবে বাঁচছে. সেটাই হল দেশ। দেশ তো কোনো মাটি নয় ,দেশ তো আসলে মানুষ। যে দেশের মানুষ যেমন, সে দেশের মন্ত্রী,নায়ক, বিজ্ঞানী, খেলোয়ার,আইকন সবাই সে রকম। যা কিছু সহজে অনায়াসে পাওয়া গিয়েছে,অর্জন করতে হয়নি, তার গুরুত্ব জাতীয় দিবসে পতাকা ঝুলিয়ে গান বাজানোতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। দায় নেই যে! তাই আমরা আমাদের তৈরি সরকার থেকে নিয়ম তৈরি করি দেখনদারির । জাতীয়তাবোধের দেখনদারি। সত্যি জাতীয়তাবোধে অনেকটা রক্ত, অনেকটা ঘাম মিশে অনেকটা প্রাণ মিশে আছে। তাই সেটা দেওয়ার বা জানার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমারা তাই জাতীয় সংগীতে উঠে দাঁড়িয়ে মেরুদণ্ড ঝুঁকিয়ে বারবার প্রমাণ করি, স্বাধীনতা কাকে বলে আমরা জানি না। আমাদের তৈরি সরকার তাই অনায়াস ফতোয়া জারি করে জাতীয় দিবসে বাড়িতে বাড়িতে পতাকা ঝোলানোর। যাতে ভোটব্যাংকের ব্যবসায় দেশ হয় সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। আসলে ওরাও যে আমাদেরই কারও বাবা,মা,কাকা,জ্যাঠা,পিসি। স্বাধীনতা ওদেরও অর্জন করতে হয়নি,কুড়িয়ে পেয়েছে।(আরও পড়ুন: ‘ভিড়ে হারিয়ে গেল ছাতা, আর হারিয়ে গেল দেশ’, মনোজ মিত্র)