ডোকলামে সংঘাতের পর ভারতের সঙ্গে এলএসি বরাবর এলাকাগুলি নিজেদের কব্জায় রাখাই এখন প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনের। লাদাখে চিনা বাহিনীর এই আগ্রাসন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলাফল। তারই জেরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে বেজিং। ভূ-রাজনৈতিক সংক্রান্ত মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা স্ট্রাটফোর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তিন বছরে চিন তার শক্তি আগের থেকে তিন গুণ বাড়িয়ে ফেলতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছে এই শক্তি বৃদ্ধিই বর্তমানে ভারতের অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্ট্রাটফোর-এরআন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ সিম ট্যাক তাঁর রিপোর্টে বলেন যে, এলএসি বরাবর সংলগ্ন এলাকায় চিন কমপক্ষে ১৩টি নতুন সামরিক অবস্থান গড়ে তুলতে শুরু করেছে। তার মধ্যে তিনটি বায়ুসেনা ঘাঁটি, পাঁচটি স্থায়ী আকাশসীমা প্রতিরক্ষা কেন্দ্র এবং পাঁচটি হেলিপোর্ট রয়েছে। ওই রিপোর্ট থেকে এ-ও মনে করা হচ্ছে যে, লাদাখ সংঘাতের পরেই হেলিপোর্টগুলি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও রেডিয়ো সিগন্যাল, রাডার এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ধারণ করার জন্য রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্টেশন। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘লাদাখে সংঘাত দানা বাঁধার আগে থেকে যে ভাবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন এলাকায় সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে চিন, তাতেই বোঝা যায় যে এর পিছনে বড় ধরনের কোনও মতলব রয়েছে। আসলে এলএসি সংলগ্ন অঞ্চলগুলিকে নিজেদের কব্জায় আনতে চায় ওরা।’রিপোর্ট অনুসারে, এলএসি সংলগ্ন এলাকায় আগে থেকে যে বিমানঘাঁটিগুলি ছিল, সেখানেও অতিরিক্ত রানওয়ে নির্মাণ থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান রাখার বাড়তি জায়গা তৈরি করতে শুরু করেছে চিন।মে মাসের গোড়ার দিকে অনিশ্চিত লাদাখ পরিস্থিতিতেও, তিব্বত মালভূমিতে অতিরিক্ত সেনা, বিশেষ বাহিনী, সাঁজোয়া ইউনিট এবংবিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট মোতায়েন করেছে বেজিং।ওপেন সোর্স স্যাটেলাইট চিত্রের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, তিব্বতের মানস সরোবরের তীরে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র তৈরি করেছে চিন। তা ছাড়া, ডোকলাম ও সিকিম সেক্টরে বিতর্কিত সীমান্তের সংবেদনশীল প্রান্তকে ঢাকতে একই রকম তৎপরতা অবলম্বন করা হচ্ছে। স্ট্রাটফোর রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত গ্রাফিক্স ব্যাখ্যা করেছে যে, ২০১৬ সালে তিব্বতে একটিমাত্র হেলিপোর্ট এবং একটি এয়ার ডিফেন্স সাইট ছিল এবং ২০১৯ সালের পর থেকে ওই অঞ্চলে সামরিক অবকাঠামোতে যথেষ্ট পরিমাণে সম্প্রসারণ ও উন্নত করেছে চিন।চিনের সাম্প্রতিক অবকাঠামোগত বিকাশের এক উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য, ‘ভারতের সঙ্গে সমগ্র সীমান্ত অঞ্চলে বায়ুসেনা প্রয়োগে নিজের দক্ষতা জোরদার করা’ এবং ‘ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ফাঁক খুঁজে’ তাকে কাজে লাগানো। রিপোর্ট বলছে, ‘চিনের নীতি হল, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে আঞ্চলিক বিরোধে ভারতকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে দ্বন্দ্ব-বিদ্ধস্ত সীমান্ত অঞ্চলে দ্রুত সেনাসমাগমের ব্যবস্থা করা।’ বলা হয়েছে, এই একই কৌশল দক্ষিণ চিন সাগর অঞ্চলেও প্রয়োগ করছে বেজিং। স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সেখানে আঞ্চলিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে প্রতিপক্ষের আর্থিক খরচাতেও টান পড়বে বলে মনে করছে চিন।বেশ কিছু ছোটখাটো সংঘাতের পরে গত ১৫ জুন ভারত-চিন সংঘাতের জেরে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয় এবং চিনেরও অপ্রকাশিত পরিমাণ সৈন্য নিহত হয়। এর পরে দুই দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর প্রায় ৫০,০০০ অতিরিক্ত সেনা সমাগম ঘটায়। সীমান্ত দ্বন্দ্বের সমাধান খুঁজতে একাধিক সামরিক স্তরের বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় গত ২৯ ও ৩০ অগস্ট প্ররোচনামূলক সামরিক অভিযানে নামে চিন, যা দৃঢ় হাতে রুখে দেয় ভারতীয় সেনা। এর পরে একাধিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় দুই পক্ষ, যার মধ্যে সীমান্তে ১৯৭৫ সালের পরে প্রথম গুলিও চলে। তবে ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ভারতীয় সীমান্তে চিনের সামরিক পরিকাঠামো গঠনের তৎপরতা দেখে বোঝা গিয়েছে, সাম্প্রতিক কালে সীমান্ত সমস্যা মোকাবিলায় নয়া কৌশল গ্রহণ করেছে চিন, যাতে নয়া দিল্লিকে জাতীয় সুরক্ষা অবস্থান নিয়ে আবার চিন্তা করতে হয়।’ ভৌগোলিক ভাবে চিনের এই নতুন পদক্ষেপ লাদাখের প্রতি নিবিষ্ট থাকলেও এর জেরে সমগ্র সীমান্ত অঞ্চলে, বিশেষ করে সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশ লাগোয়া সীমান্তে ভারতীয় সেনা পরিকাঠামো বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।২০২০ সালের শুরু থেকেই চিনের এই আগ্রাসন নীতি আটকে রাখার চেষ্টা করে চলেছে ভারত। ফলে দুই দেশের মধ্যে বহু বার মতানৈক্যের সৃষ্টিও হয়েছে এই কারণে বর্তমানে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা চালাতেই বেশি উদ্যোগী হয়েছে দুই দেশ।