চারিদিকে হিংসার ছবির মধ্যে বরাবরই মূর্ত হয়ে ওঠে কিছু সম্প্রীতি-ভালোবাসার মুহূর্ত। সেগুলিই থেকে যায় লোকেমুখে ইতিহাসে। এমনই এক সম্প্রীতির সাক্ষী থাকল কানপুর। দিনকয়েক আগেও যে কানপুরে জ্বলছিল আগুন, ছড়াচ্ছিল হিংসা।গত ২১ ডিসেম্বর কানপুরের বকরগঞ্জের খান পরিবারের মেয়ে জিনাতের সঙ্গে বিয়ে ছিল প্রতাপগড়ের হাসনান ফারুখের। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু, আচমকা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ঘিরে কানপুরে শুরু হয় হিংসা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গাড়ি, থানা, দোকান। বিয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। যেখানে দুজন গুলিবদ্ধ হন, সেখান থেকে জিনাতের বাড়ি বেশি দূরে নয়। ফলে বাড়ে আতঙ্ক। যে মহল্লায় বিয়ের গান বাজার কথা ছিল, সেই গলিতেই শোনা যাচ্ছিল পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর ভারী বুটের শব্দ।এরইমধ্যে পাশের একটি বাড়িতেও বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। উত্তপ্ত মুহূর্তে জিনাতদের মহল্লায় আসতে রাজি হয়নি ছেলের পরিবার। বিয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হন জিনাত। হাসনান ফোন করে জানান, কীভাবে বিয়েতে পৌঁছাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম ছুটেছে তাঁর। কার্ফু কবলিত থাকা এলাকা দিয়ে কীভাবে বরযাত্রী নিয়ে আসবেন তা নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন হাসনান।তাহলে উপায় কী? তা নিয়ে আলোচনায় বসে জিনাতের পরিবার। বিয়ে পিছিয়ে দিতে হবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন জিনাতের মামা ওয়াজিদ ফয়জল। কিন্তু, কারোর মাথাতেই আসছিল না, কী করা উচিত? এরকম একটি শুভ কাজ পিছিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বরযাত্রীরা আসবেই বা কীভাবে?বিষয়টি কানে যায় জিনাতদের প্রতিবেশি বিমল চাপাদিয়ার কানে। ছেলেবেলা থেকে জিনাতকে দেখে এসেছেন। এরকম বিপদের দিনে কিছু করতেই হবে - জেদ চেপে বসে বিমলের মনে। সঙ্গে জুটিয়ে নেন সোমনাথ ও নীরজ তিওয়ারি নামে দুই বন্ধুকে। হাসনানাকে তাঁরা আশ্বস্ত করেন, 'চিন্তা করো না। নিরাপত্তার জন্য আমরা বরযাত্রীদের এসকর্ট করে নিয়ে যাব।'কিছুটা ভরসা পান হাসনান। ৭০ জন বরযাত্রী নিয়ে রওনা দেন। জিনাতের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে মিনিবাস ও গাড়ি রাখা হয়। তারপরই বিমলের নেতৃত্ব ৫০ জনের মতো হিন্দু মানববন্ধন তৈরি করে এক কিলোমিটার দূরে বিয়ের জায়গায় হাসনানদের নিয়ে যান।সুষ্ঠুভাবে শেষ হয় বিবাহ পর্ব। বুধবার জিনাতের মামা বলেন, 'বরযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন বিমল ও তাঁর বন্ধুরা । জিনাত যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন।' সেদিনই বাড়িতে এসেছিলেন জিনাত। বাড়ি ফিরেই প্রথমে 'বিমল ভাইয়ার' কাছে যান তিনি। বিমলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বৈবাহিক জীবনের জন্য আশীর্বাদ করতে বলেন। জিনাতের কথায়, 'সেদিন সকালে ফোনটা পাওয়ার পর আমি বিয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বিমল ভাইয়া না থাকলে বরযাত্রী লোকেরা এখানে পৌঁছাতে পারতেন না। উনি দেবদূতের মতো আমার জীবনে এসেছেন।'যদিও তাতে বড় কিছু দেখছেন না বিমল। তাঁর কথায়, 'আমি জিনাতকে বড় হতে দেখেছি। ও আমার ছোটো বোনের মতো। কীভাবে ওর মন ভাঙতে পারি? আমরা প্রতিবেশি। বিপদের সময় পরিবারের সঙ্গে দাঁড়াতেই হত।'