পাকিস্তান ‘হাসিল’ হয়েছে
ঢাকার ধামরাই শহরের কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১১ বছরের ছেলেটার বাড়ি। বাবা নায়েব বলে গ্রামের সবচেয়ে পোক্ত বাড়িটা তাদেরই। কিন্তু সে ১৯৪৭ সালের অগস্টের আগের কথা। কাঁটাতারের এপার ওপারে যেমন বিশাল দুই ভূখণ্ড, তেমন সেই অগস্টও গড়ে দ👍িয়েছিল আগে পরে বিশাল দুই সময়খণ্ড। যার এপার ওপারে অনুভূতির বিস্তর ফারাক। ১৯৪৭, দেশ স্বাধীন হয়েছে, ভাগও হয়েছে! ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠেছে ছেলেটা। ১৫ অগস্ট ভারতের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানেরও জন্ম। সেদিন স্কুলে এসেছিল মুসলিম লিগের 𒆙কয়েকজন নেতা। পড়ুয়াদের হাতে কিছু পটকা দিয়ে বলেছিল রাতে এগুলো ফাটাবে। কেন? পাকিস্তান ‘হাসিল’ হয়েছে তাই। বাড়ি ফিরে রাতে আনন্দ করেই ফাটিয়েছিল সেগুলি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বড়দের ধমক। কারণ ১৫ অগস্টে আদতে যা হয়েছে, তা আনন্দের কিছু নয়। এই ধমক দিয়েই শুরু ছেলেটার স্বাধীনতার ‘স্বাদ’ বুঝে নেওয়ার পর্ব!
অন্য দেশ না নিজেরই দেশ?
‘স্বাধীনতার একটা রূপান্তর দেশভাগ। অনেক মানুষকেই সেটা বুঝতে হয়েছিল। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।’ ১১ বছরের ছেলেটি এখন ভারতবর্ষের অন্যতম প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক তথা সাহিত্যিক পবিত্র সরকার। সাতচল্লিশের অগস্ট তাঁর জীবন অন্য খাতে বইয়ে দেয়। সেই অভিজ্ঞতাই শোনাচ্ছিলেন তিনি। ১৫ অগস্ট দেশভাগ হয়েছিল, কিন্তু ধামরাইয়ের ছোট্ট গ্রামে তখনও বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠেনি। নায়েবের বাড়ি হলেও গ্রামের চাচা, নানারা প্রায়ই তামাক খেতে আসতেন। ভারত যাওয়ার কথা উঠলেই তাঁরা বলতেন, ‘ক্যান যাইবেন আমাগো ছেড়ে, আমরা তো আছি!’ আশ্বাস থাকলেও দ্রুত চারপাশ বদলাতে থাকে। ঢাকা থেকে মুসলিম লিগের লোকরা এসে মাঝে মাঝেই হল্লা করত। কিছু রাত বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলেও কাটাতে হয়েছে। দানা বাঁধল ভয়। গ্রামের মুসলমান প্রতিবেশিরাই তখন পরামর্শ দিলেন নায়েবকে, ‘মা-ছেলেরে ভারত পাঠায়ে দেন। আপনি থ্যাইক্যা যান।’ কাকার হাত ধরে নিরাপদ আশ্রয় ছাড়ল এগারোর ছেলে𓆉টা। অন্য দেশের উদ্দেশ্যে। অন্য দেশ না নিজেরই দেশ?
পাকিস্তানি পুলিশের সার্চ
ধামরাই থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে গোয়ালন্দে এসে ভিড়ল স্টিমার। সেখানের হোটেল থেকে কাকা খাবার নিয়ে এল। খেয়েদেয়ে রাত নটায় চাপতে হল একটি মানুষ ঠাসা ঘুটঘুটে অন্ধকার ট্রেনের কামরায়। কোনওরকমে একটা ক্ষীণ আলো জ্বালতেই সামনে কতগুলো মানুষের মুখ, অর্থশূন্য দৃষ্টি। অতীত ভবিষ্য💟ত হারিয়ে সব ভুলে যাদের কাছে বর্তমান এখন এই ঘুপচি কামরা। কুলিরা টাকা নিয়ে তাদের মাঝে জায়গা করে দিল। চাকা গড়াতে শুরু করল ঢাকা মেলের। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের তারস্বরে কান্না আর বাবাদের ঠাস ঠাস করে চড়, মেরে ফেলার হুমকি। আবছা জ্যোৎস্নার মধ্যে দিয়েই ট্রেন চলেছিল কুষ্ঠিয়া, আলমডাঙা, চুয়াডাঙা পেরিয়ে। রাত আড়াইটেয় দর্শনায় থামল ঢাকা মেল। পাকিস্তানের পুলিশ সার্🥂চ করবে।
সেসময় 𒊎একটা হইহট্টগোল পড়ে গেল। মহিলাদের সার্চ করার সময় কেড়ে নেওয়া হল শাড়ির আঁচলে বাঁধা গয়নাগাটি, সোনাদানা। পুলিশের যুক্তি, এসব পাকিস্তানের সম্পত্তি। ভারতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। অল্প সম্বল নিয়ে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল যারা, বেশ কিছুক্ষণ তাদের স্বপ্নহত্যা চলল। ছেলেটার কাকা এই লাইনে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে। তাই কিছু টাকা খাওয়ানোতে কাজ হল। ছেলেটার মাকে আর সার্চ করেনি পুলিশ। ভালোমতো চেঁচেꦡপুঁছে নেওয়ার পর ট্রেন ছেড়ে দেওয়া হল। বর্ডার পেরিয়ে ভারত ঢুকল ভাঙা দেশের সন্তানেরা।
নতুন সময়খণ্ড
জলঙ্গি পেরিয়ে রাণাঘাটে ঢুকল ঢাকা মেল। সাতটায় ঘুম ভাঙল ছেলেটার। সাড়ে আটটায় ট্রেন ঢুকল শিয়ালদায়। চারিদিকে পিঁপড়ের মতো মানুষের ঢল শুধু। জনসমুদ্র আর সার সার ঘোড়ার গাড়ি। সেসব ঠেলে ঠেলেই বড়বাজার পৌছল তিনজন। রায় লেনের এক ঘুপচি ঘরে পাঁচ-ছজনের সঙ্গেই জায়গা হল। এর পর অবশ্য ছেলেটা চলে যায় খড়গপুরে কাকার ভিটেয়। একটি মাটির ঘরে থাকার বন্দোবস্ত সেখানে। অন্য এক সময়খণ্ডে যাত্রা শুরু হল ছেলেটার। যে সময়খণ্ডে স্বাধীনতা🔜 মানে কারও কাছে দেশভাগ, কারও কাছে ক্ষমতার সুচতুর বোঝাপড়া আর কারও কাছে রবার ঘষে শৈশব মুছে কৈশোর আঁকতে থাকা।