অন্বেষা সেনগুপ্ত
বাংলাদেশ উত্তাল। কেউ শঙ্কিত, কেউ পুলকিত, কেউ হতাশ। কত রকম ছবি আমরা দেখছি খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে, সামাজিক মাধ্যমে। উচ্ছ্বাস, হিংসা, লুঠপাট, রক্ষা, সংহতি— নানা আবেগ। বারবার উঠছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার প্রশ্ন। ছাত্র, সমাজকর্মী, শিক্ౠষক, বিএনপি নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনীর অনেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত আবেদন জানিয়ে চলেছেন। নাগরিক সমাজ দল বেঁধে নানা জায়গায় পাহারা দিচ্ছে হিন্দু মন্দির। তার মধ্যেও আসছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি হিংসার খবর।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু কারা? ধর্মের নিরিখে দেখলে হিন্দু, খৃস্টান, বৌদ্ধরা। ভাষার ভিত্তিতে অবাঙালি যাঁরা তাঁরা - তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশভাগের পর বিহার উত্তর প্রদেশ থেকে আসা মুহাজির, আবার রয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়। জাতি পরিচিতির দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাকমা, গারো, সাঁওতাল, হাজঙ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের মতই বাংলাদেꦯশে সংখ্যালঘুরা ভালো নেই।
বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রের যে ধারণা বা কল্পনা, তা ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অস্থির, ভঙ্গুর ও পরিবর্তনশীল। ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক দেশ তৈরি হয়, আজকের বাংলাদেশ তখন হল পাকিস্তানের অংশ। সে সময়ের বাঙালি মুসলমান নেতা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, চাষি, শ্রমিক— সকলেরই কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে অনেক আশাআকাঙ্ক্ষা ছিল। যুক্তবঙ্গে হিন্দু 🌌জমিদার-জোতদারের দাপট, সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দুয়ানী নান্দনিকতার রমরমা, চাকরিবাকরিতে হাতেগোণা মুসলমান উপস্থিতি— এসবই পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের বড় অংশকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমরা যদি আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনী বা তাজউদ্দিন আহমদের ডাইরি পড়ি, দেখব প্রথম থেকেই তাঁদের কাছে বাঙালি ও মুসলমান দু’টি পরিচিতিই একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুর থেকে সাংস্কৃতিক ভাবে আলাদা এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি-মুসলমানী সংস্কৃতির লালন পালন হবে এই ছিল আবুল মনসুরদের মতো বুদ্ধিজীবীদের ধারণা। এই ধারণায় একটা ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার আছে। একজনের কাছে বাঙালি হওয়া ও মুসলমান হওয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, আবার কারও কাছে একটা অন্যটার চেয়ে বেশি। এই ভারসাম্যের রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তান/ বাংলাদেশে নানা মুহূর্তে সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা বোঝার জন্য মাথায় রাখা জরুরি।
পাকিস্তানের উর্দু নিয়ে পদক্ষেপ বেশিরভাগ বাঙালি-মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। যাঁরা অবশ্য তাঁদের মুসলমান পরিচিতিকেই একমাত্র পরিচিতি হিসাবে দেখতেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে নেমেছিলেন। ১৯৪৮ থেকেই এই প্রতিবাদের শুরু। এখানে উল্লেখযোগ্য— আজকের মতো তখনও ছাত্ররা ছিলেন প্রতিবাদে♔র সামনের সারিতে। আর নাজিমুদ্দিন বা নুরুল আমিন যখন উর্দু বিরোধী আন্দোলনকে ভারতীয়/হিন্দু ষড়যন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন, আন্দোলনকারী ছাত্ররা বারবার জোরের সঙ্গে বলেছিলেন এই আন্দোলন ‘আমাদের’ আন্দোলন, অভ্যন্তরীণ আন্দোলন। প্রশ্ন ওঠে আমরা কারা? অভ্যন্তর কী? সেই অভ্যন্তরে কী বাঙালি হিন্দুরা নেই? পাকিস্তানি আইন সভায় উর্দু নীতি বিরোধী প্রস্তাব সবার প্রথম আনেন কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা ধীরেন দত্ত। ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানেই ছিলেন, মারা যান পাক সেনার গুলিতে। কিন্তু তাঁর কংগ্রেসি, হিন্দু, বাঙালি পরিচয়কে সামনে রেখে মুসলিম লীগের এক অংশ সহজেই বাংলার দাবিকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র/বিদেশি দাবি হিসাবে দেগে দেয়। আসলে দেশভাগের গোদা ভিত্তি ছিল ধর্ম। দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুসারে পাকিস্তান হল মুসলমানদের দেশ আর ভারত হল হিন্দুদের। দুই দেশের প্রথম সারির রাষ্ট্রনেতারাই অবশ্য ১৯৪৭ থেকেই একাধিক বার বলেছিলেন তাঁদের দেশে নাগরিকত্ব ধর্ম, বর্ণ, জাতি ভিত্তিক হবে না। কিন্তু দেশভাগ মেনে নেওয়া, পঞ্জাবে জন-বিনিময়, ইভাকুই প্রপার্টি সংক্রান্ত নানা আইন, মহিলাদের ‘উদ্ধার ও পুনরℱ্বাসন’ নীতি— এসবই এক রকম দ্বিজাতিতত্ত্বের বাস্তবায়ন বললে ভুল হয় না। (এ নিয়ে বিশদে জানতে দেখুন জয়া চ্যাটার্জির South Asian Histories of Citizenship)। এই প্রেক্ষিতে ধীরেন দত্তের প্রস্তাব, তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচিতি, খুব সহজেই তাঁর আনা বাংলা ভাষার দাবিকে পাকিস্তান বিরোধী ও ইসলাম বিরোধী তকমা দিয়েছিল।
কিন্তু এই তকমা মানতে নারাজ ছিলেন সেইসব বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা যাঁদের কল্পনায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানি বাংলার বিকাশ স্থল৷ বাঙালি হিন্দুও তাঁদের কাছে সে সময়ে অপর, হয়তো বিদেশি বা সম্ভাব্য বিদেশি; উর্দুভাষী পশ্চিমী মুসলমানও অপর। এই আমরা-ওরার লড়াইয়ে ১৯৪৮ বা ১৯৫২ তে পাকিস্তানি সরকারি ডিসকোর্সে ‘আমরা’ হল সমস্ত পাকিস্তানি মুসলমান, ওরা হল হিন্দুরা— পাকিস্তানি হিন্দুই হোক, বা ভার🗹তীয়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ‘আমরা’ ছিলেন তাঁরাই যাঁরা পাকিস্তানি, বাঙালি, এবং মুসলমান। বাকি সবাই ওরা। তাই অভ্যন্তরের ধারণা শুধু ভাষা-ভিত্তিক তা ভাবার কারণ নেই, এ সময় সেখানে স্থান ও ধর্মের গুরুত্ব ছিল।
১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত জল গড়ালো বহু দূর। বাঙালি পরিচিতি ও বাংলা ভাষার গুরুত্ব পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে বরাবর ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে ক্ষোভ, খাদ্যাভাব, ভোলা সাইক্লোনে ত্রাণের রাজনীতি ও আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতির কন্ঠরোধ করার চেষ্টাও এই আন্দোলনকে পোক্ত করেছিল। যা এক গৃহযুদ্ধ হতে পারত, তাতে ভারতের অংশগ্রহণ, ভারতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়া, বাঙালি আবেগের উত্থান— সবমিলিয়ে ’৭১ এর মুহূর্ত দেশভাগের রাজনীতিকে ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু ভাষা, ধর্ম, স্থানের জটিল রাজনীতিকে চিরতরে মসৃণ করতে পারেনি ’৭১। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাতিল হয়নি, হিন্দু বিরোধী হিংসা থামেনি, বন্ধ হয়নি হিন্দু অভিবাসন। পাশাপাশি চলেছে বিহারি মুসলমানদের ওপর আক্রমণ, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে নানা জনজাতির উপর আক্রমণ। একদিকে আমরা ২০০১ এর সাম্প্রদায়িক হামলা দেখেছি, অন্যদিকে শাহবাগ আন্দোলন দেখেছি, তেমনি দেখেছি নাস্তিক ব্লগারদের উপর💝 আক্রমণ, হেফাজতে ইসলাম বা জামাতের মতো ইস্লামিক সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব। 𒉰বাংলাদেশ গঠনের পর, আমরা-ওরার সীমানা যেন আরও জটিল হয়েছে। বাঙালি হলেই আমরা, অবাঙালিরা ওরা - এটা এক ধরনের মত, এই মতের সঙ্গে হয়তো আওয়ামি লিগের দূরত্ব কম। কিন্তু সেই কল্পনায় দুই বাংলার মধ্যের সীমানাকে ব্যাখ্যা কিরা মুশকিল। তাই শুধু বাঙালি নয়, তার সঙ্গে মুসলমান হওয়াও ‘আমরা’ হওয়ার জন্য জরুরি অনেকের কাছে। আবার কেউ কেউ মুসলমান পরিচয়কেই প্রধান পরিচয় করতে চান— তবে তাহলে অস্বীকার করা হয় ’৭১ কে।
এই জটিল জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় নতুন মাত্রা যোগ হল ২০২৪ এর অগস্টের ৫ তারিখ। ক্ষমতা ছেড়ে পালালেন আওয়ামি লিগের প্রধান শেখ হাসিনা। কোটা বিরোধী আন্দোলন থামাতে গিয়ে উনি পরিচিত বুলি আওড়ে ছি⛄লেন, বলেছিলেন বিরোধীরা রাজাকার— অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থী, সাম্প্রদায়িক শক্তি। সেই আমরা-ওরা বা কে অভ্যন্তর সেই প্রশ্ন। কিন্তু এই ডিসকোর্স যেন মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলল। আমরা রাজাকার, তাহলে তুমি স্বৈরাচার— এই বলে রাজাকার শব্দকে লঘু করা হল, একটু হলেও ’৭১-এর মুহূর্ত প্রশ্নের মুখে পড়ল। তারপর আমরা জানি ভাঙা হয়েছে মুজিবের মূর্তি, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তাঁর বাসভবন/জ▨াদুঘর। দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেছেন অনেকে।
এই দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমরা-ওরা কারা? এটা কি ’৪৭-এর মুহূর্তকে জোরালো করল আবার? হিন্দু আক্রমণ, তাঁদের অনেকের ভারতে ঢোকার চেষ্টা সেরকম ইঙ্গিত দেয় হয়তো। কিন্তু পাশাপাশি এও ঠিক, ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ বারবার বলেছেন তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চান। আপাতত দেশের ক্ষমতায় যাঁরা, তাঁদের অনেকেরই মানবাধিকার কর্মী হিসাবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে, সাম্প্রদায়িক হওয়ার বদনাম নেই। এই উপদেষ্টাদের মধ্যে সংখ্যালঘু (হিন্দু, চাকমা) প্রতিনিধিও আছেন। আর অনেকেই বলছেন হিংসার ধরন রাজনৈতিক— মূলত আক্রান্ত আওয়ামি লিগের কর্মী, সমর্থকেরা; সাম্প্রদায়িক নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সংখ্যালঘু বিরোধী দাঙ্গা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার রাজনৈতিক উত্থান— কোনওটাই কাম্য নয়। তবে যে কোনও জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই আমরꦛা-ওরার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এবং এই ধারণার মধ্যেই নিহিত থাকে হিংসার আশঙ্কা। মোটের উপর কেজো গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক বিকাশ, মোটামুটি স্বাধীন আইন-আদালত, আমলাতন্ত্র, প🌸ুলিশ— এই হিংসাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। বাংলাদেশে আমরা কারা হবে আর ওরা কারা হবে তা বুঝতে সময় লাগবে আরও। আর আমরা-ওরার মধ্যে হিংসা নিয়ন্ত্রণে থাকবে তখনই যখন সাধারণ নির্বাচন হবে, আর তা হবে মোটের উপর স্বচ্ছভাবে। আর যত দিন এই উপদেষ্টামণ্ডলীর হাতে ক্ষমতা তত দিন সবরকম হিংসা নিয়ন্ত্রণের দায় তাঁদের, ডিসকোর্স তাঁরা যেভাবেই গড়ার চেষ্টা করুন না কেন।
(লেখক ইতিহাসবিদ। ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা'য় ইতিহাস পড়ান। মতামত ব্যক্তিগত)