ছোটবেলায় রবি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে খাবার বেড়ে অপেক্ষা করতেন তিনি। আবার খাবার খেয়ে রবির ডিউটি হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা পড়ে শোনানো। তাঁর ডিউটি সেই সময় হাতপাখা দিয়ে রবিকে হাওয়া করা। কত নিঝুম দুপুর এভাবে কেটে গিয়েছে। রবি যখন জ্যোতিদাদার সঙ্গে চন্দননগরে থাকতে গেলেন, তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র সঙ্গী। রবির বেশ অল্প বয়সে তাঁর মা মারা গিয়েছিল। তারপর তিনিই যেন আরেক মা হয়ে উঠলেন। মায়ের মতো দেখভাল করা থেকে বন্ধুর মতো লেখালেখি নিয়ে পরামর্শ দেওয়া, সব ক্ষেত্রে রবির জীবনে আবশ্যিক হয়ে উঠেছিলেন ওই কিশোরী। তিনি মৃণালিনী দেবী নন, কারণ তখনও রবির বিয়েই হয়নি। তিনি কাদম্বরী দেবী।
রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর রসায়ন
জ্যোতিদাদার যখন বিয়ে হল, তখন রবি সদ্য কিশোর। জ্যোতিদাদার স্ত্রীও সেই অর্থে কিশোরীই। দুজনের বয়স কাছাকাছি। বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি। মাতৃহারা রবির জীবনে সন্তানহীনা কাদম্বরী ধীরে ধীরে অনেকটা অধিকারবোধ নিয়ে যেন হাজির হলেন। অধিকারবোধ তৈরির আর স্থান ছিল না যে। কাদম্বরীর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একদিকে যেমন ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী, অন্যদিকে আবার কিছুটা বেহিসেবি, হুজুগে মানুষ। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার সে কথা উঠে এসেছে। ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথের মতো মতোই ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাহাজ ব্যবসা করতে গিয়েছিলেন। টিকতে পারেননি। সর্বস্বান্ত হন। স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ যুবকের সারাদিন কাটত ঠাকুরবাড়ির বাইরে। আর সন্ধে হলেই মজলিশ। এর মাঝে একা হয়ে পড়েছিলেন কাদম্বরী। বাজার সরকারের মেয়ে বলে ঠাকুরবাড়িতে বউ হয়ে আসার পর বহু নিন্দা সহ্য করেন। কিন্তু স্বামীর কাছে অভিযোগের উপায় নেই। এহেন পরিস্থিতিতে একমাত্র ভরসা হয়ে এলেন কিশোর রবি। একাকী জীবনের একমাত্র সঙ্গ।
রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি
রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সের বহু লেখার প্রথম পাঠক ও সমালোচক ছিলেন কাদম্বরী। সাহিত্য রচনার বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি। আজ এ কথা সর্বজনবিদিত। রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে দুই বছরের এই নারী রবীন্দ্রনাথকে অক্লান্তভাবে সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। ১৮৮৪ সাল। কবির বয়স ২৩ বছর। কাদম্বরী ২৫ বছরের তরুণী। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মাত্র চার মাস পর অতিমাত্রার আফিম খেয়ে প্রাণত্যাগ করলেন কাদম্বরী। কেন সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা আজও অধরা ধরা। ঠাকুরবাড়িও চিরকাল নীরব ছিল এই মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর প্রয়াণের পরেও নানা সময় নিজের জীবনে বউঠানের গুরুত্ব বারবার স্বীকার করেছেন। ‘জীবনস্মৃতি’র মতো গ্রন্থেও সেই স্বীকারোক্তি সমুজ্জ্বল।