সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর নিয়ে আতঙ্কের বীজ বুনছেন বিরোধীরা। কেন্দ্রীয় এই তিন পদক্ষেপ নিয়ে অযথা আশঙ্কায় ভোগা থেকে দেশবাসীকে বিরত থাকার উপদেশ দিলেন কেন্দ্রীয় আইন এবং যোগাযোগ, বৈদ্যুতিন ও তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী রবি শংকর প্রসাদ।হিন্দুস্তান টাইমস-কে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাত্কারে তিনি জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে আলোচনা এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেই এনআরসি কার্যকর করার পরিকল্পনা করেছে প্রশাসন। এই সংক্রান্ত নানান বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছেন সাক্ষাত্কারে।প্রশ্ন: গত কয়েক সপ্তাহে বিরোধীরা, এমনকি এনডিএ জোটের শরিক আপনার কয়েক জন সহকর্মীকেও নাগরিকত্ব, এনপিআর ও এনআরসি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আইনমন্ত্রী হিসেবে দেশের এই পরিস্থিতিকে কী ভাবে দেখছেন?রবি শংকর প্রসাদ: পরিষ্কার জানাচ্ছি, এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এর আগে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমি ও অন্যরা সিএএ, এনপিআর ও এনআরসি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত নয় বলে জানিয়েছি। সিএএ ভারতীয়দের জন্য নয়। এনআরসি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। মুসলিম-সহ কোনও ভারতীয় নাগরিকের জন্য সিএএ প্রযোজ্য নয়। এ শুধু এবং শুধুমাত্র আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি, জৈন ও বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাঁরা ধর্মীয় কারণে এ দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।অতীতে উগান্ডা থেকে পালিয়ে আসা মানুষকে নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এরপর ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের তা দেওয়া হয়। শ্রী লঙ্কা থেকে আসা তামিলদের নাগরিকত্ব দেন রাজীব গান্ধী, যার সম্পর্কে মনমোহন সিং সংসদে বলেছেন। পালিয়ে আসা সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য চিঠি লেখেন তরুণ গগৈ ও অশোক গেহলট।যখন কংগ্রেস এই কাজ করে, তখন তা সঠিক। কিন্তু আমরা (বিজেপি সরকার) করলেই, মানবিক পদক্ষেপ করলেই তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। তবে বিরোধিতা যা হচ্ছে, তা সবই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমাদের জোটসঙ্গীদের দুশ্চিন্তার বিষয়ে বলতে চাই, আমরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলব। ওঁরা আমাদেোর সমর্থন জানিয়েছেন, ওঁদের সঙ্গে আরও আলোচনা করব।এনপিআর-এর বিষয়ে বলি, এ হল জনসংখ্যা গণনার সাধারণ প্রক্রিয়া, যার সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক নেই। অনআরসি-এর জন্য যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী, ওই প্রক্রিয়া চালু করার আগে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। একটি দিন নির্দিষ্ট করতে হবে। তার পরে আপত্তি, চিন্তাভাবনা, বৈধতা যাচাই। গোটা বিষয়টিই আইনি। এখনও তার কিছুই করা হয়নি। আবার বলছি, এখনও এনআরসি নিয়ে কিছুই করা হয়নি।সিএএ, এনপিআর ও এনআরসি নিয়ে তুলনা টানা ভিত্তিহীন। আমরা সব ভারতীয়কে সম্মান করি, এমনকি মুসলিমদেরও। কোনও অভিযোগ থাকলে আমরা তা শুনতে রাজি।প্রশ্ন: আপনাদের অনুগত জোটসঙ্গীরাও প্রকাশ্যে বলেছেন, সিএএ থেকে মুসলিমদের বাদ দেওয়া উচিত হয়নি। সুখবীর সিং বাদল ও নরেশ গুজরাল (শিরোমণি আকালি দলের) এই নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন যে?রবি শংকর প্রসাদ: ওঁরা দুজনেই আমাদের জোটসঙ্গী ও খ্যাতিমান নেতা এবং ওঁদের সঙ্গে আমরা কথা বলব। সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করব না। ওঁরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন এবং ওঁদের সঙ্গে নিশ্চয় আলোচনা করব।আবার বলছি, সিএএ-এর খুব সোজা নজর রয়েছে। তিন দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে পালিয়ে আসা মানুষ যাতে মর্যাদার সঙ্গে থাকতে পারেন, তারই ব্যবস্থা করবে এই আইন। তিনটি দেশই ঘোষিত মুসলিম রাষ্ট্র এবং সেখানে সংখ্যালঘু অ-মুসলিমদের উপর অত্যাচার চলে। ব্যক্তিগত নিগ্রহ নয়, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই তাঁরা অত্যাচারের শিকার হয়েছেন।ওই তিন দেশের কোনও মুসলিমও ভারতে আশ্রয় চাইতে পারেন। গত ৫ বছরে এমন ২০০০ জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েচে এবং আমরা এখনও সে বিষয়ে উদার। তবে ওই তিন দেশের মুসলিমরা ব্যক্তিগত অত্যাচারের কারণে দেশত্যাগী হন, ধর্মীয় কারণে নয়। তাই তাঁরা আশ্রয় চাইলে আইন মোতাবেক অনুমোদন দেওয়া হবে। সিএএ শুধুমাত্র তিন দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য।প্রশ্ন: সাম্প্রতিক কালে ঘোষিত এনপিআর-এর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, এনআরসি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ হল প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু সরকার তা অস্বীকার করছে। তা হলে কি এনআরসি কার্যকর করার কোনও পরিকল্পনা রয়েছে?রবি শংকর প্রসাদ: এনআরসি-এর প্রতি আমরা দায়বদ্ধ। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা খুব পরিষ্কার। যেখানেই তা প্রয়োগ করা হোক, সম্পূর্ণ আইনি উপায়ে করা হবে। নাগরিকত্ব আইনে উল্লিখিত নিয়ম মেনেই তা কার্যকর করা হবে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরেই এনআরসি প্রয়োগ করা হবে। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে কিছু করা হয়নি, এমনকি কোনও সুনির্দিষ্ট দিনও ঠিক করা হয়নি।এনআরসি-এর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইনি প্রেক্ষাপট রয়েছে, যা মূলত ভারতীয় নাগরিকদের নাম সংবলিত একটি পঞ্জি। এনপিআর হল জনসংখ্যা পঞ্জি, যাতে ভারতের বাসিন্দাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকবে।প্রশ্ন: সুপ্রিম কোর্ট ও হাইইকোর্টের কয়েক জন প্রাক্তন বিচারপতি নাগরিকত্ব আইনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা সংবিধান বিরোধী বলেছেন।রবি শংকর প্রসাদ: আইনি বিষয়ে আমি সম্মানের সঙ্গে ওঁদের মতের বিরোধিতা করছি। আইটি খুবই পরিষ্কার। সংবিধানের ২৪৬ ধারায় নাগরিকত্ব বিষয়ে আইন তৈরি করার ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়েছে।সংবিধানের ১৪ ধারা অনুযায়ী, আইনের চোখে নাগরিক সাম্য সুনিশ্চিত করার ও সমান আইনি সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কোনও আইন তৈরি হলে তা আইনত বৈধ এবং এই ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও বিষয়টিকে যুক্তিগ্রাহ্য বৈধতা প্রদান করা হয়েছে। সিএএ-তে তিন দেশের সংখ্যালঘুদের একটি পৃথক শ্রেণি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁদের অত্যন্ত অযৌক্তিক ও অবাস্তব ভাবে দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছে।তৃতীয়ত, সংবিধানের ২১ ধারায় জীবনের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং তারই অংশভুক্ত হল মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা। সংবিধানের আর একটি ধারা সম্পর্কে কমই বলা হয়। সেই ২৫ ধারায় নাগরিকদের নিজের ধর্ম পালন ও ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ওঁদের নাগরিকত্ব দিয়ে আমরা পালিয়ে আসা সংখ্যালঘুদের সেই অধিকার সুনির্দিষ্ট করছি।প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন যে, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে সরকারের আসল উদ্দেশের বিষয়ে মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছেছে বলেই সিএএ ও এনআরসি নিয়ে এমন বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে?রবি শংকর প্রসাদ: বার বার বলা হয়েছে যে এই দুইয়ের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। সিএএ তিন ভিন্ন দেশ থেকে পালিয়ে আসা সংখ্যালঘুদের জন্য এবং এই প্রথম তা কার্যকর করা হচ্ছে না। ২০১০ সালের ৭ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পি চিদম্বরম সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, জনসংখ্যা পঞ্জিরই একটি প্রশাখা হবে এনআরসি। সেই সময় এনআরসি ও এনপিআর-এর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করার বিষয়ে জানিয়েছিল ইউপিএ সরকার। সংবিধানের ১৪ (এ) ধারায় বলা হয়েচে, প্রতিটি দেশবাসীর নাম সরকারকে নথিভুক্ত করতে হবে এবং একটি জাতীয় পরিচয়পত্র চালু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০৪ সালে তা চালু করেছিলেন মনমোহন সিং। সে সময় কংগ্রেসের কি সাহস ছিল বলার যে আমরা তা করব না...প্রশ্ন: তিন তালাক বিরোধী আইন পাশ করিয়ে টুপিতে যে পালক আপনাদের জুড়েছিল, সেই লাভের পরিমাণ কি সাম্প্রতিক পদক্ষেপের জন্য মার খেল বলে মনে করেন?রবি শংকর প্রসাদ: মুসলিম মহিলারা জানেন, নরেন্দ্র মোদী তাঁদের দাবির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রচণ্ড কঠিন সময়ে, বিরোধী নেত্রীদের একগুঁয়ে মনোভাব সত্ত্বেও আমরা ওঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম এবং তার স্বীকৃতি ওঁরা দিয়েছেন। ঐতিহ্য অনুযায়ী, আমরা (বিজেপি) মুসলিম ভোট কম পাই, কিন্তু আমাদের অন্তর্ভুক্তির নীতি পরিস্থিতি পালটে দিয়েছে।২০১৪ সাল থেকেই এই পরিবর্তন এসেছে। উজ্জ্বলা প্রকল্প, দরিদ্রদের জন্য আবাসন প্রকল্প ও আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প এই পরিবর্তনের দিশারী হয়েছে। আমাদের নীতি ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি মেনে তৈরি হয় না। সাংবিধানিক কর্তব্য পালনের উদ্দেশে তা ধার্য হয়।প্রশ্ন: ধর্মীয় নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন কারণে উত্তর পূর্ব ভারতে সিএএ-এর বিরোধিতা চলেছে। ওঁদের চিন্তা পরিচিতি ভিত্তিক।রবি শংকর প্রসাদ: নাগরিকত্ব আইনে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হয় যখন ১৯৮৫ সাল অ্যাকর্ড শিরোনামে তাতে ৬এ ধারা যোগ করা হয়। এই ধারা অসম ও উত্তর পূর্বের সংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশে পদক্ষেপের বিষয়টি আলোচনা করে। যাই হোক, এ বিষয়ে কংগ্রেস সরকার কিছুই করেনি। আমাদের সরকার উত্তর পূর্বের বাসিন্দাদের শুদ্ধতা, ঐতিহ্য ও সামাজিক কাঠামোসংরক্ষণের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওঁদের দাবির বিষয়গুলি অবশ্যই বিবেচনা করা হবে।