বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্যইজরায়েলের পছন্দের পরিভাষায় এটাকে বলে – ‘টার্গেট কিলিং’ অর্থাৎ নিজের সুবিধামতো সময়ে শত্রুকে একেবারে মুছে ফেলো। যদিও আমেরিকা এই কাজে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই অভ্যস্ত।কাসিম সোলেমানি নিজেও জানতেন তিনিই মধ্যপ্রাচ্যে সিআইএ-র পয়লা নম্বরের টার্গেট, তবু একের পর এক আমেরিকা বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করা থেকে পিছু হঠে আসেননি। সোলেমানির প্রাথমিক পরিচয় ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান হলেও তিনিই ছিলেন ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কারণ একদিকে তিনিই ছিলেন গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ও পারস্য উপসাগর এলাকায় ইরানের প্রধান স্ট্র্যাটেজি নির্মাতা, আবার হিজবুল্লা, হামাস-সহ আমেরিকা বিরোধী সব কটা সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রধান মেন্টরের রোলও প্লে করতেন অসম্ভব সাহসী এবং নিজের দেশে বিপুল জনপ্রিয় এই সোলেমানি।প্যালেস্তাইন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লেবানন জুড়ে সোলেমানির গোপন কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল। একটানা ২২ বছর ধরে তিনি কুদস বাহিনীকে সুসংহত করেছেন। এই কুদস বাহিনীই দায়িত্ব নিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করেছে , যাদের সামলাতে বারবার ব্যতিব্যস্ত থেকেছে আমেরিকা, ইজরায়েল ও সৌদি আরব ।গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই সব দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট গিজগিজ করছে। বিশেষ করে আমেরিকা, ইজরায়েল আর সৌদি আরবের। এদের মধ্যে থেকেও নিজের নেটওয়ার্কের জোরে এই তিনটে দেশকে লাগাতার বেকায়দায় ফেলেছেন সোলেমানি। ইজরায়েলের একাধিক ছক বানচাল করেছেন। সিরিয়ায় আইএস-কে হঠানোর যুদ্ধে তাঁর নির্দেশিত পথেই জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী ‘পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিট’। সোলেমানি নিজে সেই সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধফ্রন্টে উপস্থিত হয়ে উৎসাহ দিয়ে বেড়িয়েছেন। ফলে তাঁর প্রাণহানির সম্ভাবনা নতুন কিছু নয় ।একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রধান বা সেনাপ্রধানকে অন্য দেশে অতর্কিতে হত্যা কাপুরুষোচিত এবং সরাসরি সন্ত্রাসমূলক কাজ। সোলেমানির কাজকর্ম আমেরিকা ও তাঁর মিত্রদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হলেও তাঁকে অতর্কিতে হত্যার অধিকার তাদের কারো নেই। এটা যুদ্ধপরাধের পর্যায়ে পড়ে। উগ্র দক্ষিণপন্থী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশেই এই অবৈধ হত্যা সংগঠিত হয়েছে। বিনিময়ে ইরান শুনিয়েছে ভয়ঙ্কর বদলার হুমকি। কিন্তু ইরান সরাসরি যুদ্ধে নিজেদের জড়াবে না বরং সোলেমানির শেখানো পথেই হাঁটবে।সোলেমানি হত্যার পরই ইরাকের তদারকি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সেদেশের পার্লামেন্টে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে প্রস্তাব পাশ করানো হয়েছে। যদিও সোনা সরানো তো দূর অস্ত, বরং বাহিনীর বহর আরও বাড়ানোর চিন্তা করছে আমেরিকা। আসলে সোলেমানিকে হত্যা করে ইরাকে মোতায়েন নিজেদের সেনাকর্মীদেরই ঝামেলা বাড়িয়েছে আমেরিকা। ইরাক জুড়ে বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত হয়েছে গত কয়েক বছরে। তারাই দৈনন্দিন চোরাগোপ্তা হামলায় ব্যস্ত রেখেছে মার্কিন বাহিনীকে । সোলেমানি হত্যার বদলা নিতে এই মিলিশিয়া বাহিনীগুলো ইরাক সহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই তাদের আমেরিকা বিরোধী সশস্ত্র কার্যক্রম এখন আরও বৃদ্ধি করবে সেটাই প্রত্যাশিত ।এখন প্রশ্ন হচ্ছে , সোলেমানিকে হত্যার জন্য ঠিক এই সময়টাকেই কেন বেছে নিল আমেরিকা। প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরেই সরাসরি কোনও যুদ্ধে না-থাকলেও ইরাকের সঙ্গে তাদের একাধিক ফ্রন্টে রয়েছে ছায়াযুদ্ধ। আর ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের টানাপোড়েন আরও তিক্ত আকার নেয়। ট্রাম্প ২০১৮ সালে একপেশে ভাবেই ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি বাতিল করেন তিনি। আগেকার একগাদা নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোরভাবে ইরানের ওপর আরোপ করেন। সরাসরিভাবেই ঘোষণা করেন ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’-এর কথা ।আমেরিকার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়ে একঘরে করে দেওয়া। যাতে তারা আমেরিকার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। আর সেই সুযোগে সমস্ত তেলের খনির দখল নেবে আমেরিকা । কিন্তু ইরান তাদের ওপর ট্রাম্প দ্বারা আরোপিত এই ‘সর্বোচ্চ চাপ’কে বদলে ফেলে ‘সর্বোচ্চ প্রতিরোধে’। আমেরিকারই বিখ্যাত পত্রিকা ‘ফরেন পলিসি’ তাদের এক নিবন্ধে পরিষ্কারভাবে লিখেছিল – ‘সর্বোচ্চ চাপের কোনও সুফল আমেরিকা পায়নি , ইরান কূটনৈতিকভাবে কোনরকম আত্মসমর্পণ করেনি’ ।গত বছর মার্কিন প্রধান মিত্র সৌদি আরবের প্রধান দুটি তৈল ক্ষেত্রে ড্রোন হামলার অভিযোগ ওঠে ইরানের বিরুদ্ধে। এর পরই দুই দেশের সম্পর্ক চরম বৈরিতার জায়গায় যায়। যদিও ইরান অভিযোগ অস্বীকার করে কিন্তু সৌদি আরব ও আমেরিকা নিঃসন্দেহ ছিল, সোলেমানির মস্তিষ্ক ছিল ঐ হামলার নেপথ্যে। সৌদি যুবরাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে একসময় বলেছিলেন – ‘ইরানি সাপের মাথাটাকেই কেটে দিতে হবে’। এছাড়া ইজরায়েলেরও অনুযোগ ছিল কেন আমেরিকা কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না সোলেমানির বিরুদ্ধে ।দ্বিতীয়ত , উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সেই পরিচিত কায়দা – নির্বাচনের আগে যখনই নিজের দেশে নড়বড়ে অবস্থা হবে তখনই শত্রু দেশের সাথে যুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি করে উগ্র জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে দেওয়া । ফলে ট্রাম্প একঢিলে দুই পাখিই মারতে চেয়েছেন , কারন এই বছরেই আমেরিকায় ভোট। আর তাঁর নিজের অবস্থা নিজের দেশে একেবারেই ভালো নয় । কদিন আগেই মার্কিন আইনসভার নিম্নকক্ষে ইমপিচ হয়েছেন তিনি। উচ্চকক্ষে চলছে ইমপিচমেন্ট্রের প্রক্রিয়া।সোলেমানিকে হত্যা করে ইরানকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা আমেরিকা করেছে তাতে সফল হবে কিনা বলা মুশকিল। কারন প্রতিঘাতের ক্ষেত্রে ইরান বরাবরই ধীর, সুযোগসন্ধানী এবং পরোক্ষ আঘাতে বিশ্বাসী । আমেরিকার সাথে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ছায়া যুদ্ধের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে তাদের রয়েছে ।