বাংলাদেশে রবিবার থেকে খুলে যাচ্ছে তৈরি পোশাক-সহ রফতানিমুখী শিল্প কারখানা৷ সেই সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা ঢাকায় ফিরতে গিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও কষ্টের শিকার হচ্ছেন৷ অনেকেরই আশঙ্কা, সময়মতো কর্মস্থলে না ফিরলে তাঁদের চাকরি থাকবে না৷লকডাউনের পাঁচদিন বাকি থাকতেই কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হলেও দূরপাল্লার সব ধরনের যানবাহন বন্ধ আছে৷ কারখানার পক্ষ থেকেও কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷ তাই পায়ে হেঁটে, ভ্যান ও রিক্সায় করে যে যার মতো ফিরছেন৷ ফেরিঘাট আর সড়কে ঢাকামুখী পোশাক কর্মীদের যেন মিছিল নেমেছে৷মনারুল ইসলামের সাথে কথা হয় শনিবার দুপরের পর৷ তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন৷ বাড়ি সিরাজগঞ্জে৷ মনারুল বলেন, ‘সরকারের কারখানা খোলার ঘোষণার পর অফিস থেকে ফোন করা হয়, এসএমএস পাঠানো হয়৷ বলা হয় যে কোনও উপায়ে ১ অগষ্ট অফিসে হাজির থাকতে হবে৷ যদি তার অন্যথা হয় তাহলে চাকরি থাকবে না৷’মনারুল-সহ তিনজন পোশাককর্মী শনিবার সকালেই সিরাজগঞ্জ থেকে রওনা হন৷ তাদের সঙ্গে একজন নারী সহকর্মীও ছিলেন৷ তাঁরা কখনো ভ্যান, কখনও পায়ে হেঁটে, আবার কখনও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে করে ঢাকার গাবতলি আসেন দুপরের পর৷ তিনি বলেন, ‘আমাদের একজনের ঢাকায় আসতে ২৫০ টাকা খরচ হয়, কিন্তু এবার খরচ হয়েছে ৮০০ টাকা৷’ চাকরির ভয়ে সবাই যে যেভাবে পারছেন কর্মস্থলে ফিরছেন বলে জানান তিনি৷মো. আকাশ মিয়া কাজ করেন সাভারের হেমায়েতপুরের একটি পোশাক কারখানায়৷ তার বাড়ি রাজবাড়ি৷ তিনিও দুপরের পর তার স্ত্রী ও এক সান্তানকে নিয়ে সাভার এলাকায় আসেন৷ কীভাবে আসলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘রাজবাড়ি থেকে ভ্যানে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে রওনা দেওয়ার পর মাঝখানে পুলিশ নামিয়ে দেয়৷ এরপর কখনও পায়ে হেঁটে আবার কখনো ভ্যানে ফেরি ঘাটে পৌঁছাই৷ ফেরি পার হওয়ার পর তারপর আবার পায়ে হেঁটে ও ভ্যানে করে সাভার আসি৷ কী যে কষ্ট হয়েছে বলে বুঝাতে পারব না৷’কেন আসলেন? লকডাউনের পরেও তো আসতে পারতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আকাশ বলেন, ‘না আসলে তো চাকরি থাকবে না৷ তখন খাবো কী,’ জবাব আকাশের৷ এরকম ফিরে আসার কষ্টের গল্প গাবতলি ও সাভার এলাকায় অনেকের মুখেই শোনা গিয়েছে৷ কেউ কেউ এই যাত্রায় ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েন৷বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ একদিন আগে বলেছে, ৮০ ভাগ শ্রমিকই চলে এসেছে৷ যারা চলে এসেছে তাদের দিয়েই পোশাক কারখানা চালু করা হবে৷ যারা আসতে পারবে না তাদের চাকরি যাবে না৷ খোলা হবে ঢাকার আশপাশের কারখানা৷ বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম দাবি করেন, ‘‘ঈদের ছুটিতে এবার শ্রমিকরা বাড়ি যাননি৷ যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা এরইমধ্যে চলে এসেছে৷ ২০ ভাগের মতো শ্রমিক বাড়িতে আছেন৷ তাঁদের যে শনিবারের মধ্যে আসতে হবে তা নয়৷ লকডাউন শেষে আসলেও চলবে৷’জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও বলেছেন, শ্রমিকরা না আসতে পারলে তাদের চাকরি যাবে না৷ কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি উল্টো৷ ফিরে আসা পোশাক শ্রমিকরা বলেন, তাঁদের ফোন করে এবং মেসেজ দিয়ে তাদের কারখানা থেকে বলা হয়েছে, শনিবারের মধ্যে আসতে হবে৷ না আসতে পারলে চাকরি থাকবে না৷জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য লিগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘বিজিএমইএ অসত্য কথা বলছে৷ ইদের ছুটিতে শতভাগ শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন৷ তাঁরা এখন খোলার খবরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ আগে কোনও শ্রমিক ঢাকা আসেননি৷ তাঁদের চাকরির ভয় দেখিয়ে এই লকডাউনের মধ্যেও আসতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ কিন্তু তাদের জন্য কোনেও ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷’ তিনি আরও বলেন, ‘পোশাক শ্রমিকরা বিপাকে পড়ে আমাদের ফোন করছেন৷ কিন্তু আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারছি না৷ তাঁরা অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে কর্মস্থলে ফিরছেন৷’বিজিএমইএ'র প্রাক্তন সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিকরা যেভাবে গিয়েছেন, সেভাবেই ফিরছেন৷ তাঁরা দুই ইদেই এরকম করেছেন৷ এই ইদে তাঁদের বাড়ি না যেতে বলা হয়েছিল৷ কিন্তু তাঁরা গিয়েছেন৷ এখন খোলার খবর পেয়ে ছুটে আসছেন৷ তবে কেউ আসতে না পারলে চাকরি যাবে না৷ আমরা চাই না যে এই ভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেউ আসুক৷’ অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রোববার থেকে পুরো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পোশাক কারখানা চালু হচ্ছে৷ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট-এর কারণে আমরা আরো বেশি সতর্ক থাকব৷’ বাংলাদেশে সাড়ে চার হাজারের মতো পোশাক কারখানায় ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন৷ যাদের অধিকাংশই নারী৷ এই শ্রমিকরা এখন ছুটছেন গণপরিবহন বিহীন লকডাউনের মধ্যে৷